সম্প্রতি, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো আমার সাথে।আপনাদের অদ্ভুত নাও মনে হতে পারে।একটা সিনেমার সাথে কি মিল ভাবতে পারবেন না। ঘটনাটা বাস্তবের সাথে না সিনেমেটিক রেয়ালিস্মের মত ঠিক বলতে পারব না।আসলে, বাস্তব কখন সিনেমা আর কখন সিনেমা বাস্তব হয়ে ওঠে, এ আমার মত লোকের পক্ষে বলা বেশ কঠিন কাজ। যারা আমার বন্ধু বা আমাকে চেনেন তারা অনেকেই হয়তো জানেন যে আমি ছবি তুলতে ভালবাসি এবং অনেক সময় বেরিয়েও পরি পথেঘাটে ছবি তুলতে। দীর্ঘ ২৫ বছরের অভ্যেস, এখনও সাথে রয়ে গেছে আরকি।
কয়েকদিন আগে, চিৎপুরের এক ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে আছি, লাল আলো কখন সবুজ হবে বলে। আলো সবুজ হল, ঠিক তখনি একটি ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করলো, দাদা আপনি কি ছবি তোলেন? উফ, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির হর্নের চিৎকার আর দাঁড়াতে দিলনা। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভাবলাম, না ফিরে যাই। কেন একটা অচেনা ছেলে আমাকে এ কথা বলল। মুহূর্তের মধ্যে নিজের সাথে একপ্রস্থ প্রশ্নোত্তর পর্ব সেরে ফেললাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম, ফিরে এলাম ক্রসিং এর কাছে। মনে হল লাল রং আর কিছুক্ষণ থাকলেই হয়তো ভাল হত। খুঁজতে শুরু করলাম ছেলেটাকে। ভাবলাম মুহূর্তের মধ্যে উবে যেতে তো পারেনা একটা জলজ্যান্ত মানুষ। অবশেষে খানিক দুরে এক চায়ের দোকানে ওকে দেখলাম। ওই দোকানেই ও কাজ করে। আমাকে দেখেই একটা স্পেসাল চা নিজেই বলে দিলো।আমার মধ্যে অবাক হয়ে যাওয়া অনুভূতিটা আরও গাঢ় হতে লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম আমাকে কি দরকার? উত্তর এলো প্রশ্ন হয়ে, আপনি ছবি তোলেন তো? আমি বললাম হ্যাঁ ওই তুলি আরকি। ছেলেটি বলল “আমার কাজ হয়ে গেছে”। মানে?
এবার সে বলা শুরু করল, ওর নাম ধাম ইত্যাদি। আর বলল, বেশ অনেক দিন আগে নাকি আমি ওদের বাড়ির কাছেই ছবি তুলতে গেছিলাম। সেখানে আমি ওদের চায়ের দোকানে বসা ওর বাবার ছবি তুলেছিলাম। তখন ওদের নিজেদের চায়ের দোকান ছিল। এখন আর নেই। এখন ও অন্যের দোকানে কাজ করে।বেশ কিছুদিন আগে ওর বাবা গত হয়েছেন।ওদের বাড়িতে ওর বাবার কোন ছবি নেই। ও আমার তোলা সে ছবিটি চায়। একটা কথা বলার পর আমার বুকফাটা কান্না হজম করতে হল, “দাদা কিছু লাগলে দেব, কিন্তু বেশি টাকা দিতে পারবনা”। এক মুহূর্তে মনে হল জীবন এত কঠিন, আর জমা হল বুকের কাছে এক ডুংরি ব্যাথা।সে কিছুতেই বেরোতে চাওয়ার নাম নিচ্ছিলনা।
এই কথা শোনামাত্র, শিরায় শিরায় উত্তেজনা, না হয়তো, অন্যও কোন নাম না জানা অনুভূতি গুলি সক্রিয় হয়ে উঠল। এর পর শুরু হল বুঝে নাওয়া, কবে? কোথায়? কখন? কি?। চেপে বসল এক ধরনের জীবনবোধ, জেদ। মনে হতে লাগল অনেকবার হার্ডডিস্ক্ এর প্রবলেমের জন্য অনেক ছবি নষ্ট হয়ে গেছে।এটা যেন থাকে। নিজেকে সমাজে পরিচয় দিয়ে থাকি নাস্তিক বলে, আবার কখন ইংরেজিতে কায়দা করে এথিয়েস্ট ও বলি। আসলে নাস্তিক ও এথিয়েস্ট এর মধ্যে অনেকটাই ফারাক। যাইহোক, মাথার ভেতরে ঘটতে থাকল বিভিন্ন রাসায়নিক কারিগরি, তার ফাঁকেই ‘হে ভগবান’ বলে নিলাম।
নিজের ফোন নাম্বারটা ওর হাতে দিয়ে, বাড়ি গিয়ে খুঁজে দেখব প্রতিশ্রুতি দিলাম।বাড়ি ফিরে আসার সময় একটা সিনেমার কথা বারবার মনে পড়ছিল। Krzysztof Kieślowski এর “ক্যামেরা বাফ্” যারা দেখেছেন তারা ঠিক বুঝে গেছেন। বিশেষত, যেখানে সিনেমার প্রধান চরিত্র ফিলিপ মস এর তোলা তার বন্ধুর মায়ের সামান্য কয়েক মুহূর্তের ভিডিও, কি ভাবে বন্ধুর মায়ের মৃত্যুর পর তার বন্ধুর কাছে সেই ছবি ও সে গুরুত্ব পাচ্ছে।যেখানে ছবি জীবন হয়ে উঠছে আর জীবন ছবি।আমারও বারবার এ কথা মনে পরছিল।
প্রচুর খুঁজেছি বাড়ি এসে ছবি। অনেক দিন আগে তোলা ছবি, তখন অনেক বছর আগে তোলা হয়ে গেছে।আমরা হয়তো এই ভাবেই জীবন খুঁজি নিরন্তর।
স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।