উত্তর কলকাতার অন্ধকার গলিতে মিলিয়ে যাওয়া অর্জুনদা আবার কোথা থেকে যেন উদয় হল। পার্কে দৌড়চ্ছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে ডাক পড়লো ‘অ্যাই বাবলা’। দাঁড়িয়ে পরলাম কোন উপায় নেই যে। না দাঁড়ালে, যা নয় তা শুরু করে দেবে সবার সামনে। সামনে এসেই আমায় বলল ‘অনেক হয়েছে এবার চল, একটা কথা আছে’। বলেই চায়ের দোকানে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। আমার মুখ নাকি খাঁটা, ওই আরকি। দিলাম ধরে ব, খ, চ। চুপচাপ শুনে বলল ‘হয়েছে? না আরও দিবি?’। বললাম কি হয়েছে বলো? বলতে শুরু করল অর্জুনদা, ‘তোকে শালা মন খুলে একটু কথা বললাম বোকাচো…… ফেসবুকে ছেপে দিলি মালটা? ঠিক করলি?’ আমি আমার স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বললাম দুর ছাড়তো। ফালতু না ভাঁজিয়ে কি বলবে বলো? আমার সোজা হিসেব, বিশ্বাস না করলে তোমার গোপন চুলকানি নিয়ে কিছু বোলনা প্লিজ। লিখেছি সত্যি তোমার কথা কিন্তু তোমার আসল নামটা তো ব্যাবহার করিনি। তাহলে তোমার চাপ কোথায়? এবার ব্যাটা নিজেই বলল ‘ঠিক আছে ছাড় ও কথা, জানিস আজ কাকে দেখলাম?’। মহামুশকিল !!! আমি জানবো কি করে? এবার সে বলা শুরু করলো। যেহেতু, লেখালেখির হাতযশটা আমার নিতান্তই বাজে, তাই আমি আমার মতো করে আপনাদের শোনাবো ওর গপ্পো।
সেই বছর মানে আশির দশকের মাঝামাঝি কোন এক সময় পরিবারের সাথে আমি এলহাবাদ গেছিলাম ঘুড়তে। ওই সময় যেমন হত, আরও এক দুটো পরিবার জুটে যেতো আর সবাই মিলে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে বেড়িয়ে পরতো। এত ট্রাভেল এজেন্সির রমরমা ছিল না। ঐ সময় কুণ্ডু ট্রাভেল্স ছিল কিন্তু সেখানে একটু উঁচু ক্লাসের লোকজন যেতো হয়তো। মোদ্দা কথা আমারা যাইনি। সময়টা শীতকাল ছিল কারণ আমরা হোল্ডঅল বেডিং নিয়ে হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। রাতে শোবার সময় ওটা থেকেই কম্বল বের করে দেয়া হয়েছিল। যতদূর মনে পরে আশেপাশের তিন চারটে কূপে আমাদেরই লোকজনেরা ছিল। তাই এক কূপ থেকে আরেক কূপে বারবার যাতায়াত করছিলাম। আসলে কূপের দরজা ঠেলা দিয়ে খোলার একটা মজা ছিল, আর একটা ক্যেতও ছিল বটে। নিজেকে বেশ বড় বড় লাগছিল বোধহয়, তাই এতো ঘনঘন অন্ধকূপ যাত্রা করছিলাম। একবার, এই রকম কূপ নিয়ে কপাকুপির খেলার মাঝে অন্যও কোন এক কূপের এক কাঁটা সুন্দরীর দেখা পেলাম ট্রেনের কামরার ঐ সরু গলিতে। ব্যাস, আমার আকাশ বাতাসে কেমন যেন একটা প্রেম প্রেম আবহ তৈরি হয়ে গেল। ‘পাগলা খাবি কি, ঝাঁজেই মরে যাবি’ এ কথা বাজারে তখনও আসেনি। আর যদি এসেও থাকে অন্তত আমার জানা ছিলনা। সত্যি বলতে আমার একদম সেই অবস্থা হল। মেয়েটি সাদা রঙের সালওয়ার কামিজ পরা তার ওপর দুধে আলতা গায়ের রঙ। আমার অবস্থা অনেকটা ‘ইন দ্য ভোগ অফ মা’। এ প্রবাদের জন্মের অনেক আগের কথা বলছি অবশ্য। কূপে ফিরে এসে মাথা ঘুরতে লাগলো। এতো সুন্দর কি কেউ হতে পারে? ভেবে। বারবার মনে হতে লাগলো ও কি আমাকে দেখছিল? কি না? স্বাভাবিক ভাবে মন যা বলার তাই বলছিল, হ্যাঁ আমাকে দেখছিল, আলবাৎ দেখছিল। আমিও তো কম যাইনা তখন, হলুদ রঙের টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরা রীতিমত হ্যান্ডু। অবশ্য সেটা আমি নিজে নিজে ভাবতাম। আটটা না বাজতেই সবার কেমন যেন ঘুমের নেশা পেলো। ভারি বেগতিক, সবাই ঘুমিয়ে পরলে আমি তো আর কূপের বাইরে যেতে পারবনা। তাহলে ওকে আবার কি ভাবে দেখবো? কি করলে আবার তাকে দেখা যাবে ভাবতে লাগলাম। মাকে বললাম, মা, লাস্ট একবার জয়ন্তদা দের কূপ থেকে ঘুরে আসি? মা অনুমতি দিলেও ব্যাগরা দিলো দাদা। এই প্রথম আমার নিষ্পাপ মনে কাউকে খুন করার ইচ্ছে জন্মাল। তখন বাজার চলতি সব গালাগালি আমার কণ্ঠস্থ। ওখান থেকে দু চারটে মনেমনে দিতেদিতে জোরজার করে বেড়িয়ে পড়লাম। হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হল। কেউ নেই ঐ ট্রেনের গলিতে। ভেতরে আসতেই, দাদা গলাধাক্কা দিয়ে শুয়ে দিলো আমাকে।
সত্যি বলতে ঘুম আসতে চাইছিলনা। বারবার মুখটা ঘুরে ফিরে আসছে। তখন আমার পূর্ণযৌবন। যা যা মাথায় এসেছিল সেদিন তা যদি আমি এখানে নিয়ে আসি অর্থাৎ অনেকটা ধরুন যদি ক্যমুর মতো লিখতে চাই। ছাড়ুন, বাদদিন অতদুর গিয়ে লাভ নেই। ভাবুন যদি রঙ্গন চাটুজ্যের ভাসায় লিখি। তাহলে ব্যাপারটা পূর্নাঙ্গ মাত্রায় ইয়ে হয়ে যাবে। কি যেন একটা বলে না? আনু টানু জাতীয়। মনে পড়ছেনা। যাইহোক, আমি একটা খেলা খেলতাম সেই সময়, অবশ্য এখনও খেলি। যার সাথে কথা বলার ইছা হত বা কোন কথা কাউকে বলতে চাই, হয়তো সামনে তাকে কোনদিনই সে কথা বলা হয়ে উঠবেনা, তাকে প্রথমে কল্পনায় নিয়ে আসা, তারপর বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করা মনেমনে, আর তারপর তারসঙ্গে বা আরও অনেক চরিত্র এক জায়গায় নিয়ে এসে জমিয়ে কথা বলা। এই ভাবে চলতো সে খেলা। সেদিন সারারাত ওর সাথে আমার গল্প চললো এভাবেই। একটা আশঙ্কা কাজ করছিল মনে, যদি রাতে সে ট্রেন থেকে নেমে যায়। তাহলে কি হবে? একটু দুঃখ নিয়ে বিলাসও করলাম। খেলার ফলে, ঐ বিশাল লম্বা রাত বেশ খানিকটা ছোট হয়ে গেল।
ভোর হল। খানিক বাদে, তোরজোড় শুরু হল। কিসের বুঝতে পারছিলামনা। অবশেষে, মা এসে বলল দাঁত মেজে জুতো পরে নিতে। কারণ, খানিক বাদে এলাহাবাদ এসে পরবে। রেডি হয়ে গেলাম, বেড়িয়ে পড়লাম কূপ থেকে। আমার চোখ তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে, অল্প খোলা দরজা থেকে বেড়িয়ে আসা এক টুকরো সাদা কাপড় জানিয়ে দিলো, সে আছে। এলাহাবাদ ষ্টেশনে নামা হল, পাশে দাঁড়িয়ে সে। এইবার লক্ষ্য করলাম সেও আমাকে সত্যি সত্যি দেখছে। মনে হচ্ছিল, ছোট্ট চিরকুটে বাড়ির ল্যান্ড লাইন ফোন নাম্বারটা দিয়ে দিই। সাহস হলনা। আরেকটা ব্যাপার কাজ করছিলো, হারিয়ে ফেলার অনুভূতি। একটা জেদ চেপে বসলো ‘কিছুতেই হারাতে দেবনা’। একবার চিল্লিয়ে দাদাকে বললাম দাদা আমাদের নাম্বারটা ‘ফাইভ ফাইভ ফাইভ টু নাইন এইট’ তো? মানে শেষে আট আছে তো। দাদা এই শুনে খেঁকিয়ে উঠল। ওর সামনে বকা খেয়ে কি যে লজ্জায় পরেছিলাম। তার ওপর দেখলাম ওর মুখে মৃদু হাসি। লজ্জায়, কোথায় যে লুকবো নিজেকে।
তখন আমি নিজেকে অরণ্যদেব আর দাদাকে জঘন্যদেব ভাবছি। তাই অরণ্যদেবের মতো ‘অউ্ রেভ্যয়’ বলে বিদায় দিলাম প্রেমকে। এতো কষ্ট হচ্ছিলো এই ভেবে যে ওর নামটাও জানা হলনা। বুকে মোটামুটি দু চার পিস্ পাথর চাপা দিয়ে এসে উঠলাম হোটেলে। খানিকবাদে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে, লক্ষ্য করলাম ঘরে একটা বারান্দা আছে। গিয়ে দাঁড়ালাম। মনেহল ডান পাশে গোলাপি ছায়া। তাকিয়ে দেখি অবাক কাণ্ড। এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে লাল টী-শার্ট পরে বেড়িয়ে এলাম। আমার হারানো প্রেমের কাম ব্যাক। দু’দিন ছিলাম সেখানে। আর ঐ দু’দিনে ফেলুদা হয়ে যা যা জানতে পারলাম, ওর নাম প্রের্ণা আগারওয়াল, ক্লাস ইলেভ্নে পড়ে। একটু বড় ছিল আমার থেকে, তাও মনকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম। বেশ কেটেছিল ঐ দু’দিন। যেদিন ওরা হোটেল ছাড়ল। সেদিনটা বেশ মনেপড়ে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে সিঁড়ির সামনে। আর ওর বাড়ির সবাই নেমে আসছে একদম পেছনে ও নামছে। লক্ষ্য করলাম, ও চোখের ইশারায় কিছু বলল। কিন্তু আমি বুঝলামনা। আসলে ঐ সময় মেয়েদের চোখের ভাষা বোঝার মতো দক্ষতা তৈরি হয়নি। আজও হয়েছে তেমনটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। দেখলাম প্রের্ণা নিজের রুমালটা ঠোঁটে মুছে রেখে গেলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি ঘিরে ধরল আমায়। সারাশরীরে শিহরন হল, মনে হল এক ঝটকায় বড় হয়ে গেলাম। সবাই চলে যাওয়ার পর কুড়িয়ে নিলাম রুমাল। খুলে দেখি লিপস্টিক দিয়ে লেখা সেই মহার্ঘ্য তিন শব্দের বানী আর সাথে ফোন নম্বর।
ফিরে এলাম কলকাতা। এসেই লাফিয়ে গেলাম ফোনের কাছে। ঘুরিয়ে ফেললাম সেই নাম্বার। না সে সেখানে থাকেনা। সে ভুলে গেছিলো এসটিডি কোড লিখতে তার নম্বরের সাথে। আর আমারও জানা ছিলনা ওর শহরের নাম। তাই সব পেয়েও হারিয়ে ফেললাম সবকিছু। ধুস !!! যা হবার তা হবেই। তা নিয়ে ভেবে আর আজ লাভ নেই।
ফিরে আসি আজকের কথায়। আজ নাকি, মানে পঁচিশ বছর বাদে অর্জুনদা হাওড়া স্টেশানে একজনকে দেখেছে। সে নাকি সেই হারিয়ে যাওয়া প্রের্ণা। ও যাকে দেখেছে, প্রের্ণার বয়স হলে ঠিক ঠিক তার মতোই দেখতে হবে। তাই আজ অর্জুনদা বেজায় খুশি। ভাবলাম, মানুষের ভেতরের কারখানাটা বেশ অদ্ভুত। অনুভূতির জন্মের রশদের বীজ কত আদিম হতে পারে।
স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।