সেদিন পার্কে বসে সবাই মিলে ঠিক করা হল, এই বছরে আমরা পার্ক থেকে সবাই মিলে একটা পিকনিক করবো। যেমন কথা তেমনি কাজ। কোথায় যাওয়া হবে থেকে মেনু সব ঠিক হয়ে গেলো তক্ষুনি। দিন ক্ষণ তারিখ সব ঠিক হয়ে গেলো সেই মুহূর্তেই সেখানেই বসে। কথামতো নির্দিষ্ট দিনে, এক শীতের সকালে সবাই মিলে এক জায়গায় হলাম সাথে অর্জুনদাও, গন্তব্য বনগাঁর আগে চূর্ণীর তীরে নামহীন এক ফালি জমির ওপর হবে পিকনিক। জায়গার একটা নামও আছে অবশ্য কিন্তু সরকারের কাছে তা মূল্যহীন। আসলে ওটা দিলিপের দেশের বাড়ি। ও হ্যাঁ ! দিলিপ আমার সকাল বেলার বন্ধু, পার্কের বন্ধু আরকি। এবার আসি অর্জুনদার কথায়। এক সময় অর্জুনদা মফঃস্বলে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছিল। আর পিকনিকে যাওয়ার পথেই এসেছিল সেই জায়গা, আর যে গাড়িতে করে আমরা পিকনিক যাচ্ছিলাম সেখানে আশির দশকের সব হিন্দি রোমান্টিক গান বাজছিল। মানে, কফিন কেনা হয়ে গেছে মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্খায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অর্জুনদা উঠে এলো আমার পাশের সিটে। পাশে বসতেই বুঝে গেছি, কি হতে চলেছে। আমার সোজা প্রশ্ন অর্জুনদাকে, আবার কিছু মনে পড়ল নাকি তোমার?। স্বাভাবিকভাবে উত্তর এলো ‘আর কি, হ্যাঁ রে, অনেক কথাই তো মনে আসছে’। এবার শুরু করল বলা, ‘এইতো দেখ বাবলা, দ্যাখ দ্যাখ দ্যাখ’ !! ‘এটা দিয়ে গভর্নমেন্ট কলেজে যেতে হত’।
এই গলি দিয়ে খানিকটা গেলে প্রবীর স্যারের বাড়ি ছিল। আমি বায়োলজি পড়তে আসতাম। বায়োলজি প্র্যাক্টিকাল আর ছবি আঁকতে আমার মোটেও ভাল লাগতো না। বিশেষ করে ব্যাঙের পৌষ্টিক তন্ত্রের ছবি, তাই আঁকতে হবে ভাবলেও এখনও গায়ে জ্বর আসে। প্রবীরদার ব্যাচে আমার সঙ্গে আরেকটা ছেলে পড়তো, মানে আমরা দুজন পড়তাম একটা ব্যাচে। হঠাৎ একদিন গিয়ে দেখলাম আরেকটি মেয়ে এসে জুটেছে, নাম জুন। জানলাম ও আগে থেকেই পড়তো প্রবীরদার কাছে, সময় বদলে আমাদের ব্যাচে এসেছে। জুনের মতো এতো লম্বা মেয়ে, আমি তখনও দেখিনি। অবশ্য পরে জেনেছিলাম ও পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। যাইহোক, গায়ের রং সামান্য মাজা, ছিপছিপে গড়ন, মুখটাও ভারি সুন্দর। বলতে পারি একবার দেখলে, ওর দিকে আরেকবার চোখ যাবেই। সেদিন পরা শেষ করে আমরা তিনজন স্যারের বাড়ির বাইরে এলাম। আমরা দুজনে নিজেদের সাইকেল বার করতে গেলাম। এসে দেখি জুন আর এক্স ১০০ বাইকের ওপর বসে কিক মারছে। দেখেইতো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। এই মনেহয় প্রথম কোন মেয়েকে বাইক চালাতে দেখা। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে মফঃস্বলের এক মেয়ে বাইক চালাচ্ছে, এটা সত্যিই বিরল বেপার স্যাপার ছিল। প্রথম দু চারদিন এই ভাবেই কেটে গেল ক্লাস। একদিন ক্লাসের মাঝে প্রবীরদা বললেন জুন খুবিই ভাল ছবি আঁকে নাকি। আঁকার কথা শুনতেই, ক্লাসের শেষে জুনের সঙ্গে আঁকা নিয়ে কিছু কথা হল। আসল উদ্দেশ্য ছিল যদি ফ্রিতে আমার বায়োলজি প্রাক্টিকাল খাতার জন্য আঁকিয়ে নেয়া যায়। আর পেনটিংস্ নিয়ে আমার দৌড় তখন মাইকেল এঞ্জেলো, পিকাসো, আর ভিঞ্চি অবশ্য তখনও আমার কাছে ভেঙ্কচি কাটার মতন। পাতি কথা হোল কিচ্ছু বুঝিনা আঁকার। পরবর্তী কালে ছবি দেখা আর ভালোলাগার বিষয়টা অনেকটা পেয়েছি আমার ভাইয়ের মতো অমিতের থেকে। কিন্তু তার বীজ আসলে ছিল জুন।
একদিন জুন এসে আমার হাতে একটা বই দিলো, হাতে নিয়ে দেখি আরভিং স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’। বললাম এটা কি বা কেন? উত্তর এলো ‘তুমি যে স্টারি স্টারি নাইট শোন, সেই ভ্যান গগ্কে তোমায় দিলাম, পড়ো তোমার ভাল লাগবে’। একটু ঘাবড়ে ছিলাম সেইদিন তার একটা কারণ ছিল। বই তো দিলো ক্লাসের শেষে। ক্লাস চলাকালীন, ঘাবড়ে যাবার মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা টেবিলে আমরা চারজন মুখোমুখি বসতাম। সেদিন, মন দিয়ে প্রবীরদার পড়া শুনছি। হঠাৎ, খেয়াল করলাম আমার পা বেয়ে আরেকজনের পা উঠছে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। খানিক বাদে আবার সেই পা, এবার সেই পায়ের ভাষা যেন আমার পায়ের সাথে খেলতে চায় তাই ডাকতে এসেছে অমন। সামনে তাকিয়ে দেখি জুনের নিস্তেজ মুখের মাঝে এক শয়তানি চোখ, যে শয়তানির ভাষা আমি ছাড়া ওখানে কেউ আর বুঝবেনা। আমি কিন্তু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বোকা হয়ে বসে। যতধিক আমি ভয় পেলাম ওর পা ততটাই সাহসী হয়ে উঠল। এবার ওর পা আমার থাইএর ওপর। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই ঘটনা ঘটিয়ে, বাইরে এসে ‘লাস্ট ফর লাইফ’, বুঝে উঠতে পারলামনা। একটু ন্যাকা ন্যাকা লাগছে হয়তো। তাহলে বলি, এইটুকু বুঝতে পারছিলাম তার আমার প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করছে। কিন্তু আমি বুঝেও না বোঝার ভান করলাম।
ক্লাস ক্লাসের মতো চলতে থাকল। আমার বাড়ি ফেরার সঙ্গী গেল বদলে। জুন হল আমার নতুন ফেরতসঙ্গী। ক্লাসের শেষে জুন আমাকে আসেপাশে নিয়ে যেতো জায়গা দেখতে। কোন জায়গা পছন্দ হলে তার পরের দিনেই সেখানে যেতো ছবি আঁকতে বা তখনই বসে পড়তো আঁকতে। একদিন হল কি, এক খোলা মাঠে গিয়ে বসে পড়ল জুন, বেশ পছন্দও হল ওর জায়গাটা। কিন্তু সেদিন ও কোন আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে যায়নি। ওর অবশ্য ব্যাগে রং আর তুলি থাকতোই। রং তুলি আছে, কিন্তু আঁকবে কিসে? খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরলো। তারপর পাঁচ দশ মিনিটের জন্য আমাকে দাড় করিয়ে রেখে কোথাও একটা গেলো। ফিরে এসেই আমার জামা টানাটানি করতে শুরু করলো। দিলাম খুলে জামা। মানে বাধ্য হয়েছিলাম খুলে দিতে। সেদিন আমার পিঠ হল ওর ক্যানভাস। শুনলাম, পিঠে ল্যান্ডস্কেপ নয়, লিরিকাল অ্যাবস্ত্রাকশান আঁকবে। এই প্রথম শুনলাম লিরিকাল অ্যাবস্ত্রাকশান টার্মটি। নিজের মতো করে আমাকে বোঝাতে লাগলো আর তার সাথে সাথে চলল ওর তুলির টান আমার পিঠের ওপর। কি যে এঁকেছিল সেদিন আমার জানার কোন উপায় ছিলনা। এখন হলে ফট করে মোবাইলে একটা ছবি তুলে দেখা হয়ে যেতো। তখন সে উপায় ছিলনা।
এই ভাবেই চলছিল বেশ দিনগুলো। অনেক ছবি এঁকে উপহারও দিয়েছিল আমাকে। মাঝেমাঝে একটা কথা বলত জুন “বিলীন থিওরি”। যতটুকু বুঝেছিলাম এর মানে, তা হল জীবনটাও নাকি অ্যাবস্ত্রাক্ট পেন্টিঙ্গের মতো। তুলির টানে এক জায়গায় এসে রং নাকি বিলীন হয়ে যায়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় আরেক রঙের খোঁজ। জীবনেও নাকি ওর মতে রঙের মতো, কখনো হাল্কা, কখনো গারো, রঙের পরিবর্তন আবার কখনো একই রঙের অনেক শেডের খেলা। সত্যি বলতে এ কথা বোঝার বয়স হয়নি তখনও আমার। মনে হত, জুন যেহেতু আমার থেকে বছর দুয়েকের বড় তাই হয়তো অমন কথা বলতে পারে। তখন, আমার আকাশে বাতাসে ভ্যান গগ্, ভ্যান গগের কাঁটা কান থেকে স্যালভাডোর ডালির সুরিয়াল ছবি হয়ে ফ্রিদার কোলে দোল খাচ্ছে। তখন যেন আমি নিজেই একজন আঁকিয়ে। লম্বা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর পায়ে কোলাপুরি চটি আর হাতে সিগারেট। একদম, শেষের কবিতার অমিত রায়। অবশ্য, বলতে দ্বিধা নেই, আদবে আমি তখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত অমিত রায়কে টুকছি। শুধু মনে আসত জুন কি কেটি?
যাইহোক, এই ভাবেই চলল দিন। বেশ ছিল সেই দিনগুলোর আকাশ বাতাস। আজও, সেই মেঘের আকার দেখলে জলছবি গুল ছায়াছবির মতো সুগন্ধি ছড়িয়ে যায়। একদিন সারাদিন ছবি আঁকলো জাতীয় সড়কের ওপর বসে। যাবার সময়, অন্য দিন গুলর মতো বলে গেল আগামীকালের সময় ও জায়গা যেখানে দেখা হবে। কথা মতো, পরের দিন সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সঠিক সময়। তার আর দেখা নেই। একটার পর একটা চলতে থাকলো সিগারেট। আর অপেক্ষা না করে গেলাম ওর বাড়ি। গিয়ে দেখি তালা দেয়া। সে তালা আর কোনদিনই খোলা হয়নি। বাস্তব রূপ পেলো জুনের “বিলীন থিওরি”। রেখে গেল, এক গুচ্ছ নাম, মগজের মধ্যে ছবি তৈরির কৌশল, ছবির প্রতি অসম্ভব এক ভালবাসা, কিছু স্মৃতি, তুলি আর রং।
এখন মনে পরে সেদিন রেনে্ ম্যাগ্রিতে্র একটা বিখ্যাত ছবি “দ্যা লাভারস্” এর কথা ও বারবার বলছিল। সত্যি বলতে এই কথা ও অনেকবার আমাকে বলেছে। এ কথা বললেই আমি বলতাম আমাকে এঁকে দেবার কথা। সেদিন বলে গেছিলো “যেদিন সত্যি দেখা হবে, সেদিন আমি ঐ ছবি আঁকবো তোমার জন্য”। সেদিন এ কথার মানেই বুঝতে চাইনি। এ ঘটনার কিছু বছর বাদে একটা খবর পাই, জুনের পরিবার বম্বেতে থাকে, আর জুন বিদেশে রয়্যাল একাডেমীতে পড়ছে। তারপর, কেটে গেছে আরেক যুগ। দুই যুগ চলে গেছে এই খবর মগজে রেখে। বেশ কিছুদিন আগে কোন এক আঁকিয়েদের ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় চোখ বোলাতে বোলাতে চোখে পড়লো, এক মহিলার ওপর। মাথার সব চুল না হলেও অনেক পাঁক ধরেছে। কল্পনায় তুলি ধরতেই বেড়িয়ে এলো জাতীয় সড়কের ওপর বসে থাকা সেই বাচ্চা মেয়েটি রুবি।
স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।