চলনা দীঘার সৈকত ছেড়ে, ঝাউ বনের ছায়ায় ছায়ায়
শুরু হোক পথ চলা, শুরু হোক কথা বলা।
দীঘার সৈকতে একটু সময় কাটায়নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। দীঘা যেন কলকাতার লোকজনের কাছে জল ভাত হয়ে গেছে। বৌ নেই বাড়িতে, বাঃ দারুন সুযোগ, কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে বাঙালি বেশি ভাবে না, চল দীঘায় ঘুরে আসি। নতুন গার্লফ্রেন্ড? আর হাতে একটা দিন পাওয়া গেছে, চল দীঘায় ঘুরে আসি। অমুক দিন বনধ্ ডেকেছে, পর পর তিন দিন টানা ছুটি পাওয়া গেছে, চল দীঘায় ঘুড়ে আসি। অনেক দিন ভালো করে বন্ধুবান্ধবের সাথে বসা হয়নি, শরীর মন ভেজেনি বেশকিছু দিন, চল দীঘায় ঘুড়ে আসি। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জায়গার বাঙালির, উইকএন্ড এলেই দীঘা পায়। সত্যি বলতে এক সময় দীঘায় ট্যুরিস্ট এর এত ভিড় ছিলনা, যার জন্য দীঘা ছিল এক নির্জন সমুদ্র সৈকত। ভালও লাগতো ঝাউবনে ঘুড়ে বেড়াতে, নির্জনে প্রিয় মানুষের সাথে সমুদ্রে গা ভাসাতে। এখন এত ভিড় হয় যে দীঘা যেন ক্রমশ অ্যালার্জিতে পরিণত হচ্ছে। তাও দীঘার আকর্ষণে একটুও ভাটা পরেনি শেষ তিন দশকে, বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে, আরও গভীর হচ্ছে সেই ভালবাসা ও আকর্ষণ।
যাদের এখনও দীঘা বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়নি তাদের জন্য এইবার দু এক কথা। এতক্ষণে সবার বোঝা হয়ে গেছে দীঘা পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। দীঘার ওপর বিগত বেশ কিছু বছর এত ট্যুরিস্ট এর চাপ বেড়েছে যার ফলে দীঘা থেকে মাত্র ২ কিমি দুরে গড়ে উঠেছে “নতুন দিঘা” বা যা “নিউ দীঘা” নামে বেশি পরিচিত। এবার একটু দীঘার ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক। আমার আবার একটু ইতিহাসের পাতিহাঁস না করলে খাবার হজম হয়না। যাইহোক, তখন বাংলার ভাগ্য বিধাতা ব্রিটিশরা এবং বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনিই নাকি আজকের দীঘার আবিষ্কর্তা। তখন অবশ্য দীঘার নাম দীঘা ছিলনা। ১৭৮০ সালের বেঙ্গল গেজেট এ বিরকুল নামক এক গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায় যেটা মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। যেখানে বর্তমানের দীঘা অবস্থিত। যতই ওয়ারেন হেস্টিংস তার আবিষ্কর্তা হন না কেন, আজকের দীঘা, দীঘা হয়ে ওঠার পেছনে যার সব থেকে বেশি অবদান, তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় মহাশয়। এটা অবশ্য ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীন হবার পরের কথা।
সত্যি বলতে দীঘার প্রচুর উন্নতি হয়েছে অবশ্যই ট্যুরিজ্ম এর দিক থেকে। তার ফলে দীঘায় বেড়েছে মানুষের ভিড়, শান্তিতে নির্জনতা উপভোগের দিন গেছে চলে। তাই এখানে অফ্ সিজ্ন বলে কোন কথা নেই। এখানে সারা বছরই হল সিজ্ন, মাঝে মধ্যে সপ্তাহের প্রথম দিকটা খানিক ফাঁকা থাকে। সেই সময় গেলে আপনি খানিকটা শান্তি পেতে পারেন এবং হোটেলও পাবেন সস্তায়। তবুও ওল্ড দীঘার থেকে নিউ দীঘা অনেক দিক থেকে শান্তির। তাই চেষ্টা করবেন নিউ দীঘাতে হোটেল নেবার।
কি কি দেখবেন:-
ক) মেরিন অ্যাক্যুরিয়াম এন্ড রিসার্চ সেন্টার
মেরিন অ্যাক্যুরিয়াম এন্ড রিসার্চ সেন্টার (MARC) অবশ্যই একটি দেখার মতন জায়গা। ২০০৪ সালের ৪ঠা জুলাই এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এখানে দেশের সর্ববৃহৎ মেরিন অ্যাক্যুরিয়ামটি আছে। ২৪টি বড় মাপের ট্যাঙ্ক এবং ৮টি পরিষ্কার জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে। তাতে রয়েছে নানান ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী।
খ) শিব মন্দির
দীঘা থেকে মাত্র ৮ কিমিঃ দুরে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক শিব মন্দির। এটি বাংলা ও ওড়িশার সীমানায় অবস্থিত। অবশ্যই দর্শনীয় একটি স্থান, কিন্তু যারা দীঘা ঘুড়তে যান তাদের অধিকাংশ লোকই এক অন্য মানসিকতা নিয়ে যান দীঘায়, তাতে সকাল সকাল শিব মন্দির দর্শনটা তাদের কাছে বারাবারি মনে হতে পারে। আশাকরি বুঝতেই পারছেন আমি কোন দিকে ইশারা করছি। তাও যদি আপনার মনে ইচ্ছা হয় বা হঠাৎ আপনি ধার্মিক হয়ে ওঠেন তাহলে ঘুড়ে এলে মন্দ লাগবে না।
গ) উদয়পুর সৈকত
যদি দীঘার ভিড়ের হাত থেকে একটু শান্তি চান, তাহলে উদয়পুর সৈকতে বেরিয়ে আসুন। শান্ত নিরিবিলি সৈকত এবং পাশে রয়েছে বিশাল ঝাউবন। সূর্য রেগে থাকলে একটু জিরিয়েও নিতে পারবেন ঝাউএর ছায়ায়। দীঘা থেকে খুব বেশি দুরে নয়। গাড়ী পাবেন, পাবেন মোটরে চলা ভ্যানরিকশা এবং ভাড়াও খুব কম।
কি কি করতে পারেন:-
কেনাকাটা – দীঘায় কিন্ত হস্তশিল্প এবং ঝিনুকের তৈরি নানান ধরনের গহনা পাওয়া যায়। সেই জিনিসের দাম কিন্ত শহরে খুব বেশি। খুশি হবার কিছু নেই দীঘাতেও আপনাকে দরাদরি করতে হবে, তা না হলে ঠকে যাবার সম্ভবনা থাকবে। কেনাকাটা করার সবথেকে ভাল জায়গা হল ওল্ড-দীঘা এবং সেখানে রয়েছে অনেক গুলো বাজার। রয়েছে বটতলা বাজার, ক্ষণিকা মার্কেট, নেহেরু মার্কেট এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট বাজার। এছাড়া পাবেন কাজুবাদাম, কিন্ত দামের দিক থেকে খুব কম নয় বরং কলকাতায় এর থেকে অনেক ভাল কাজু কমদামে পাওয়া যায়। এবার আসুন একটু মুক্ত জ্ঞান দি, মানে মুক্ত কেনা নিয়ে জ্ঞান। ভারতের মোটামুটি সব সমুদ্র সৈকতেই একটা মুক্ত বিক্রির চলন আছে, দীঘাও এর ব্যাতিক্রম নয়। সাবধান, মুক্ত কেনার আগে ভালও করে দেখে নেবেন এবং পরখ করে নেবেন আসল কিনা।
ওয়াটার স্পোর্টস – দীঘার সৈকতে আজকাল ওয়াটার স্পোর্টস এর বেশ চল হয়েছে। রয়েছে নানান ধরনের ওয়াটার স্পোর্টস এর সরঞ্জাম। একটা কথা মাথায় রাখবেন, আগে ভাল করে দর করে তবেই ভাড়া করবেন সরঞ্জাম। দীঘার ঐ টানা ২৩ কিমিঃ সৈকতে আপনি বিনা দ্বিধায় মেতে উঠতে পারেন ফুটবল, ক্রিকেট, ভলি, এমনকি কাবাড্ডিও মন্দ হবে না। আর রয়েছে কিছু রুগ্ন ঘোড়া, তাতে চরে একটু ঘুড়ে বেরালে বেশ ভালই লাগবে।
অন্যান্য – বেশ অনেকটা সময় সমুদ্রে স্নান করে পেটে টান পরেছে, না বালির ওপর বসে একটু ডাবের জলের সাথে গরম গরম মাছ ভাজা খাবার ইচ্ছা হয়েছে। এটারও বেশ সুযোগ রয়েছে এখানে। চলে যান ২ কিমিঃ দুরে মোহনায়, সেখানে রয়েছে বেশ বড় মাছের বাজার। সস্তায় মিলবে নানান সামুদ্রিক মাছ। কিনে নিয়ে চলে আসুন ওল্ড-দীঘায়, রয়েছে রান্না করিয়ে নেবার সুযোগ। সকাল সকাল সৈকতেও দেখা পাওয়া যায় জেলেদের, তাদের থেকেও কিনতে পারেন মাছ। তাছাড়া সকালের দিকে তাজা খেজুরের রস পাওয়া যায়, একটু খেয়ে নিতে পারেন। কারন শহরে চট করে এসব পাওয়া মুশকিল। এখন দীঘাতে হয়েছে রোপ-ওয়ে, উঠে বসতে পারেন, মন্দ লাগবে না আকাশ পথে দীঘা ভ্রমন।
দীঘার সরাইখানা
দীঘা হল হোটেলে ঘেরা একটা জায়গা এবং হোটেল ব্যবসার স্বর্গরাজ্য। যে দিকে তাকাবেন সেখানেই চোখে পরবে হোটেল এবং পাওয়াও যায় বেশ সস্তায়। কোন বিশেষ দিন ছাড়া হোটেলে জায়গা পাওয়া খুবই সহজ। আগে থেকে বুকিং করার কোন দরকারই নেই। কোন বিশেষ দিনে যেতে চাইলে বেশ কিছুদিন আগে থাকতে হোটেল বুকিং করে নেবেন। তা না হলে কিন্ত হোটেল পেতে নাজেহাল হতে হবে। সস্তা থেকে স্টার হোটেল সবই পাবেন দীঘাতে। দরদাম করবেন মন খুলে, তাতে অনেক ভালও হোটেল মিলবে বেশ সস্তায়। মনে রাখবেন ওল্ড-দীঘার থেকে নিউ-দীঘার হোটেলের ভাড়া একটু বেশি। কিন্ত একটু ভেতর দিকে বা বীচ্ থেকে একটু দুরে নিলে সস্তায় ভালও হোটেল পাওয়া যায়।
কি ভাবে যাবেন
সড়কপথে
দীঘার সাথে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভাল। বেশ ঘনঘন বাস ছাড়ে কলকাতার ধর্মতলার শহীদ মিনার এর কাছ থেকে। এছাড়া রয়েছে প্রাইভেট কার, তাতে অবশ্য ভাড়া বেশি। কলকাতা থেকে দীঘার দূরত্ব ১৯০ কিমিঃ এবং যেতে লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। West Bengal State Road Transport Corporation (WBSRTC) – এর বাসও রয়েছে, ভাড়া সাধারণের সাধ্যের মধ্যে। কিন্ত ট্রেন চালু হয়ে যাবার পর থেকে বাসে দীঘা যাবার চল প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে।
আকশ পথে
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দীঘার সব থেকে কাছে অবস্থিত, যেটি রয়েছে কলকাতাতে। তাই দীঘা যেতে হলে আপনাকে কলকাতাতেই নামতে হবে।
রেল পথে
দীঘায় সব থেকে আরামদায়ক হল ট্রেন এ করে যাওয়া। সকালের দিকে বেশ কয়েকটা ট্রেন ছাড়ে হাওড়া থেকে। দীঘার স্টেশনটি আছে নিউ-দীঘা এবং ওল্ড-দীঘার মাঝখানে, তাই হোটেল নিতে হলে আপনাকে খানিকটা চলতে হবে।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।