ঝরা সময় # ফিলিং ৬


এক পৃথিবী, যেখানে আমি, আমি হতে চাই, তুমি নও বা অন্য কেউ নও।

কিছু ছবির মতো স্বপ্ন চোখের সামনে ভেসে যায়।
কখনো ফেলে আসা সময়, কখনো বা আগাম সময় ধরা দেয় চোখের জলে।
বুঝিনা কেন সেখানে ঘাস আজও সবুজ।
বুঝিনা কেন সেখানে জল আজও বর্ণহীন।
বুঝিনা আকাশ কেন আজও গিরগিটির মতো রঙ বদলায়।

 

অদ্ভুত ব্যাপার, সত্যিই অদ্ভুত, একটি হারিয়ে যাওয়া মুখ, ঠিক সেই মুখ আরেকজনের মধ্যে খুঁজে বেড়ানো, মানুষের এক সত্যিই অদ্ভুত প্রবিত্তি। এমনটাই ঘটেছিলো অর্জুনদার জীবনে। এই গল্পতে, যেখানে চেহারার মিলের থেকেও নামের মিল খুঁজে পাওয়ার যে কি অসম্ভব চেষ্টা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, তাই আজ বলবে অর্জুনদা।

পিঙ্কি নামটা গেঁথে গেছিলো মনে। জীবনের প্রথম দিকের উষ্ণতা অতো সহজে সেরিব্রাল হেমিস্পেয়ার থেকে বিদায় নেয়না। এ আমার থেকে আর কেউ ভাল বোঝেনা। তখন কলেজে পড়ি, সদ্য প্রথম বর্ষের ছাত্র। খানিক রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি হয়ে গেছিল তা হলফ করে বলতে পারিনা কিন্তু স্থানীয় অঞ্চলে মানুষজন খানিক চিনতো। তাই, নিশানের দম্ভের পরিচয় পাইনি কলেজের শুরুতে আর বাদ বাকিদের মতো। সেই সময়, আমাদের দলের মতো ঠিক ঐ পন্থি আরেকটি রাজনৈতিক দল ছিল। ছিল কি, আজও আছে। পন্থা এক হলেও ওরা আমাদের বিরোধী ছিল রাজ্যসভায়। সেই থেকেই ওরা আমাদের বিরোধী কিন্তু বিরোধী হলেও শত্রুর তকমা ওদের গায়ে লাগেনি তখনও। ওদের দলের একটি মেয়ে আমাদের কলেজে ভর্তি হল, নাম পিঙ্কি। কি অদ্ভুত পরিহাস, অবিকল না হলেও বেশ অনেক কিছুই মিল ছিল ছেলেবেলায় ফেলে আসা পিঙ্কির সাথে।

ওর চেহারাটা এতোটাই আকর্ষণীয় ছিল, শুধু আকর্ষণীয় কেন, এতোটাই আভিজাত্য পূর্ণ ছিল যে ও আসেপাশে থাকলে ওর উপস্থিতি অনুভব করা যেতো। মাঝারি গড়ন, ফর্সা ছিপছিপে চেহারা, ও হ্যাঁ আরেকটা বিষয় তা হল ওর মতন সহজ ভাবে বিদেশি কায়দায় ইংরেজি বলতে আমি খুব কম মানুষকে দেখেছি। আর তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ। খুব কম ছেলে সোজা ভাবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে, এমন দুটো চোখ। আমি অন্য দলের হলেও, ওদের অনেকের সাথে আমার ভাল পরিচয় ছিল। সত্যি বলতে ওদের দলের মানুষ গুলকে আমার বেশ ভাল লাগত। কিছু আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও, আমাকেও যে ওরা পছন্দ করে সেটা বুঝতাম। একদিন, কলেজের বাইরে বসে আছি। দেখলাম ওদের রাজ্য কমিটির রিতাদি এলো। ওদের দলের অনেকের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে, আর সেখানে পিঙ্কিও আছে। দুর থেকে রিতাদি আমাকে দেখতে পেয়ে, ওদের ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। এসেই আমাকে গাল টিপে খুব আদর করলো। রাজনীতি করা মানুষ জনের ব্যাবহার ভাল হয় কিন্তু এই ভাবে অন্য দলের একজনকে দলের এতো উঁচু পদে থাকা কেউ এই ভাবে প্রকাশ্যে আদর, খুব অবাক করেছিল ওখানে দাড়িয়ে থাকা অনেককে। স্বাভাবিক ভাবে পিঙ্কিও অবাক হয়েছিল মনে হয়। আমার সাথে ওদের সবার পরিচয় ছিল শুধু পিঙ্কির সাথে ছিলনা। তাই রিতাদি পিঙ্কির সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলেছিল “দেখ এটা আমার ভাই, বড্ড ভাল ছেলে, খুব ব্রাইট ছেলে, মানুষের পাশে থাকার মতো মানুষ, দল দিয়ে ওকে বিচার করিসনা, ওকে দেখিস একদিন খুব নাম করবে কিন্তু রাজনীতি করবে না, মিলিয়ে নিস আমার কথা”। মেলাতে হয়নি, রাজনীতির পাঠ আমার সত্যি বহু আগেই চুকে গেছে। যাইহোক, এই আলাপ হল আমার ওর সাথে।

রিতাদির কথা গুলো মনেহয় বেশ মরমে ঢুকেছিল পিঙ্কির। তাই, মাঝেমাঝে দেখা হলেই আমার সাথে কথা বলতো। সত্যি বলতে একসময় আমার মনে হতো ও আমাকে খুঁজে বেড়ায় কথা বলার জন্য। এরপর ওর সাথে আমার ঘনঘন কথা হতে লাগল। কথার শুরু হয়তো হতো রাজনীতি দিয়ে, তারপর সাহিত্য, ছবি, জার্মানি, রাশিয়া, হয়ে রাইটার্স থেকে বানতলা। আসলে ওর ইংলিশ মিডিয়াম টাইপের রেলা ছিল না। মানে কথায় কথায় ইংরেজি ঝারা আরকি। এক টাকার ঝালমুড়ি কিনলে ও অনেকটা খেয়ে নিতো। আর তখন এক টাকায় অনেক ঝালমুড়ি হতো। কনভেন্টে পড়া একটা মেয়ের যে ঘ্যাম বা রেলা হবে ভেবেছিলাম, তা সত্যি ওর মধ্যে ছিলনা। ও জানত যে, আমি ইংলিশ গান যতই শুনি বা ইংরেজি কায়দা মারি, আমার ইংলিশের অবস্থা কত খারাপ। আর একটা কাজ যেটা ও খুব ভাল পারত তা হল মাইল মাইল হাঁটতে। পাহাড়ি জায়গায় বড় হয়েছে বলে মনে হয় ও এতো হাঁটতে পারতো। অনেকদিন এমন হয়েছে যে কলেজের সামনের মেট্রো স্টেশান থেকে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে চলে গেছি কথা বলতে বলতে খেয়ালই নেই। অনেক কথার ফাঁকে একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওকে, ‘কনভেন্টে পড়েও তুমি কি ভাবে ভাবলে মানুষের পাশে থেকে কাজ করবে? এই প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে ও বলেছিল ‘আমি থাকব, তুমি সরে যাবে, দেখো’। অনেক কিছু শিখেছিলাম ওর থেকে, আসলে ওর পড়াশোনাটা ছিল। যা আমার কোনদিনই ছিলনা, আজও নেই। একদিন কলেজে, আমার দলের মিছিল হবে আমি দাড়িয়ে আছি ভিড়ের মধ্যে। দুর থেকে পিঙ্কি আমাকে ইশারা করে বোঝাতে চাইল ‘কথা আছে’। সব কাজ সেরে গিয়ে দেখা করলাম। হাতে এলো কামুর ‘আউটসাইডার’। বইটা হাতে দিয়ে বলেছিল ডিকশনারী দেখে পড়ার চেষ্টা করবে না, না বুঝলে আমি বুঝিয়ে দেবো। ওর থেকে নিয়েই আমার প্রথম ‘হার্ডি বয়েজ’ পড়া। আমার ইংলিশটা যাতে একটু পদের হয় তাই এই ছিল ওর চেষ্টা। টিক-ট্যাঁক টেরর, পেন্টাগন স্পাই, নাইট অফ দ্যা ওয়্যারউল্ফ, আরও কত বই দিয়েছিল পড়ার জন্য। এই ভাবেই চলছিল আমাদের সম্পর্ক।

যে সময়ের কথা, সে সময় রাজ্য রাজনীতি থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বড্ড খারাপ অবস্থা। আমাদের দলের লোকেরা তখনও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে অথচ জানেও না এক শ্রেণির মানুষের আমাদের দলের প্রতি ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম, নিজের চোখে একদিন। সবাই দাড়িয়ে আছি কলেজের সামনে, সামান্য দুরে দাড়িয়ে ওদের দলের লোকেরা আর মাঝে পিঙ্কি। সেই সময়, এক মহিলার রেপ কেস নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তুঙ্গে, তার সাথে বাসের ভাড়া বৃদ্ধি, ইংরেজি তুলে দেওয়া এবং আরও নানান ইস্যু নিয়ে সবার মধ্যে ক্ষোভ। দুর থেকে দেখতে পেলাম, পিঙ্কি খুব হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। আসলে ও খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে, খুব আস্তে আস্তে কথা বলার মেয়ে। ওর মধ্যে এতো উত্তেজনা দেখে অবাক হলাম। হটাৎ দেখলাম ও হনহন করে পাঁচমাথা মোড়ের দিকে চলতে লাগলো। আমি ফুটপাথ পার হয়ে ওকে ফলো করতে লাগলাম। একা একটা মেয়ে মিনি বাস থামিয়ে তার ওপরে উঠে এমন উত্তেজিত করে দিলো পরিস্থিতি। সেদিন দেখেছিলাম আগুন পাখি। ও প্রায় একাই পাঁচমাথা মোড় বন্ধ করে দিলো। ২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল সেদিন শ্যামবাজারের পাঁচমাথা মোড়। পুলিস ব্যাপক লাঠি চার্জ করেছিল ওদের দলের লোকজনদের ওপর। বেশ আহত হয়েছিল ও। সেদিন পুলিস তুলে নিয়ে গেছিলো পিঙ্কিকে। আমার দলের অনুগত পুলিসের হাতে তখন পিঙ্কি। তাই লকআপে থাকাকালীন দেখা করতে পারলাম না।

দুদিন পর ওকে কোর্ট থেকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। ছাড়া পেয়ে আমার সাথে দেখা হয় কিন্তু আর কথা হয় না। একবার শুধু আমাকে ডেকে বলেছিল, ওটাই সম্ভবত ওর সাথে শেষ কথা, বলেছিল ‘আনুগত্য আর দালালির মধ্যে ফারাক করার শিরদাঁড়া তোমার নেই’।

কলেজের শেষের দিকের ঘটনা তাই কলেজ ছেড়ে দেবার পর ওর সাথে আমার আর দেখা হয়নি। এরপর গড়িয়ে গেছে প্রায় নয় দশ বছর, ওর সাথে কোন যোগাযোগ ছিলনা আমার। মানে আজ থেকেও বারো তেরো বছর আগের কথা বলছি। তখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছি। আমি তখন পুরদস্তুর কর্পোরেট। একদিন অফিসের গাড়ি থেকে কোন একটা কাজের জন্য পাঁচমাথা মোড়ে নেমে পড়েছি, প্রায় নটা বাজে তখন। রাস্তা পার হতে গিয়ে থমকে গেলাম। মাথার বেশ অনেকটা চুল পেকে গেছে, মাজা গায়ের রঙ, শীর্ণ শরীর, বাসের জন্য দাড়িয়ে আছে পিঙ্কি। অবাক হয়ে গেছিলাম ওকে দেখে, কোথায় সেই ঝলসানো রূপ? যেন সব কিছু কেড়ে নিয়েছে রাজনীতি। সামনে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম চিনতে পারছো? উত্তর এলো ‘না, একটু আলোতে এসে দাঁড়ান আজকাল চোখে বড্ড সমস্যা হচ্ছে’। তাও চিনতে পারলো না। নিজের পরিচয় দিলাম ‘আমি অর্জুন’। সাথে সাথে জ্বলে উঠল ওর মুখ, আর মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাসেও হয়ে গেল। শান্ত গলায় বলল ‘কেমন আছ? ভাল চাকরি করো শুনেছি, লেখালেখি করো আগের মতো? না  একদম ছেড়ে দিয়েছ?’। ভাল আছি আর লেখায় ইতি টেনেছি, এই উত্তর দিয়েই, প্রশ্ন করলাম কি করে জানলে চাকরি করি?। উত্তর এলো ‘ঐ যে মানুষের পাশে আজও আছি’। খানিকক্ষণ কথা হল। বললাম চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। উত্তর এলো ‘বেশ অনেকবার তোমাদের পুলিস আমাকে লকআপে নিয়ে পিটিয়েছে, পা দুটো শেষ গো, হাঁটতে যে বড্ড কষ্ট হয় আজকাল’। আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল সেদিন ওকে দেখে আর ওর কিছু কথা শুনে। বেশ অনেক বছর হয়েছে ও বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। এখন থাকে পার্টির কম্যুউনে। সেখানে অনেক বাচ্চা ছেলে মেয়ে থাকে, আর কিছু হত দরিদ্র পরিবার। তাদের দায়িত্ব ওর ওপর আর পার্টির ফুল টাইমার হিসেবে পার্টির সব কাজই করতে হয়। পৈতৃক সূত্রে যা সম্পত্তি পেয়েছে তা দান করেছে পার্টিকে। বাসে ওঠার আগে বলে গেল ‘উত্তর কলকাতার গায়গায় লাগান বাড়ির সরু গলিতে চড়া রোদের সন্ধ্যে নামলে আজও অর্জুন দেখা দেয়, ভাল থেকো আর পারলে ঐ ম্যঁ ব্লা কলমটা এখনও থাকলে ওটির সঠিক ব্যাবহার করো’।

এর পর আর দেখা হয়নি। কেটে গেছে আরও দশ বারো বছর। কয়েকদিন আগে বিদ্যুৎ মাশুল বৃদ্ধির প্রতিবাদে ওদের দল আন্দোলন করছিলো। ধর্মতলাতে ওদের দলের এক বিক্ষোব সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে নেমে এসে প্রেস বাইট দিচ্ছিল পিঙ্কি। সেটাই চোখে পড়লো টিভিতে সেদিন। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছিল ওকে। এক বুক দীর্ঘশ্বাস আর উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি সরু গলিতে ফেলে আসা সময়, এখন ছায়াছবি।

 

স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।

যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।

বং ব্লগার

"বং ব্লগার" একজন আস্ত পাগল, অশিক্ষিত, জ্ঞানগম্য হীন ট্রাভেলার। পথের সম্বল সামান্য পুঁজি যা মাঝে মাঝে জোটেও না, আর মনে অজানাকে জানার ও দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়ত, সবটাই ভোরের স্বপ্ন, তাতে কি যায় আসে? হয়তো সবটাই কাল্পনিক, তাতেও কি কিছু যায় আসে? সবটা মিলিয়েই আমি চিৎকার করে বলতে চাই, আমি "বং ব্লগার"।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × two =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.