সময় গুলো হয়তো পর পর সাজানো নয়, অনেকটাই ঘেঁটে যাওয়া, অস্পষ্ট তবুও আমার অর্জুনদার জীবন বুঝে নিতে আজকাল খুব অসুবিধা হয় না। এবার ওই লিখুক ওর কথা, আমার হোক বিদায়।
তখন ক্লাস ইলেভেন বা টুয়েলভ হবে। আমার খুব কাছের বন্ধু অমর। অমরের বাড়িতে আমার বেশ যাতায়াত ছিল। আসলে ওর বাড়ির ছাদের একটা ঘরে আমাদের আড্ডা হতো। সিগারেট বিড়ি খাওয়ার ঠেক, আর আমার বুদ্ধি খোলার জায়গা। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল অমরের সোনোডাইনের টেপডেক। ওই সময় প্রচুর গান শুনেছি আর তার সাথে চলতো নানা রকমের ড্রাই নেশা। কত রকমের যে ভুলভাল এক্সপেরিমেন্ট করেছি তার কোন ঠিক ছিলনা। গাঁজা খেয়ে ফিজিক্স পড়া আবার না খেয়ে পড়া। শেষের কবিতা গাঁজা নিয়ে আবার গাঁজা হীন ভাবে। বেশ লাগত এসব আর ভাল লাগত ওর বাড়ির ছাদ। আর এই সব কাণ্ড করতাম বলে আমার নাম হয়ে গেল ক্ষ্যাপা। অমরদের যৌথ পরিবার, তাই এই তুত ওই তুত করে অনেক ভাই বোন। অমরের নিজের বোন হল মিষ্টি। আমি ওদের বাড়ি ঢুকলেই ঠিক মিষ্টি এসে বলত ‘দাদা ক্ষ্যাপা এসে গেছে’। কেউ যদি না থাকতো তাও আমি একা গিয়ে বসে থাকতাম কারণ ওদের বাড়িতে আমার প্রবেশ ছিল অবাধ। নেশা করতে হলে ওটাই ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। আসলে কেউ কিছু বলত না, আমি বেশ প্রশ্রয় পেতাম। আর নেশা করার জন্য আমার একটু বিচ্ছিন্ন না হলে পোষাত না। শুধু তাই নয়, আমার একটু নিজের সাথে নিজের ইন্টার্যাকশান না করতে পারলে সেই সময় বারবার মনে হত, যেখানে চাইছি সেখানে রিচ্ করতে পারছিনা। আসলে এক বিখ্যাত মানুষের একটি উক্তি আমাকে খুব ইন্সপায়ার করতো “It’s an herb and a flower. God put it here” এই রকমই কিছু একটা ছিল, সম্পূর্ণ লেখাটা আজ মনে নেই, তবে এই লাইন দুটো ছিল যতদূর মনে পরে। যে ঘরে বসে আড্ডা দিতাম, সেই ঘরটা আর তার পরিবেশের সাথে আমার একটা আত্মিক যোগ তৈরি হয়ে গেছিলো। ওদের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অন্যের বাড়ি মনে হলেও, ছাদে পা রাখলেই একটা নিজের নিজের অনুভূতি নিজে থেকেই শরীর অনুভব করতো। দেশলাই বাক্স, টুকরো নোংরা কাপড়, ছাই ফেলার জায়গা, পিঠ চুলকলে কোন দেওয়ালে ঘষলে আরাম পাবো, কোন দিকে দাড়িয়ে গোপন কিছু করলে বাইরে বেরবে না, তাও জানা ছিল। আরেকটা ঘর ছিল যার সাথেও আমার সখ্যতা তৈরি হয়েছিল সেই সময়। আমাদের বাড়িতে সেই সময় যে মাসি কাজ করতো তার কেউ ছিলনা। একাই একটা মাটির বাড়িতে থাকতো। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমি খুব জেদ করেছিলাম ওর বাড়িতে আমি গিয়ে থাকব বলে। মাসি আর এদিকে মা দুজনকেই রাজি করে ফেললাম। আমি সারাদিন ওর বাড়িতেও মাঝে মাঝে গিয়ে থাকতাম। আর মাসি সেই সময় আমাদের বাড়িতে কাজ করতো। আস্তে আস্তে মাসির মাটির বাড়ির একটা ছোট্ট ঘরের প্রেমে পড়লাম। মানে তখন আমার, অমরের বাড়ির ছাদের ঘর আর এই কুঁড়েঘর দুটোই প্রিয় জায়গা।
টানা বেশ কয়েকদিন অমরের বাড়ি না গিয়ে এই মাটির ঘরে গেঁড়ে বসলাম, জুনের দেয়া ‘লাস্ট ফর লাইফ’ পড়ব বলে। আসলে ভ্যান গখ্কে মাটির ঘরে নিয়ে আসাই ছিল উদ্দেশ্য। তাই এই বনবাস নিয়েছিলাম। বসে পড়ছি আর তার সাথে চলছে ধোঁয়া। হটাৎ, চমকে উঠলাম মিষ্টির গলা পেয়ে ‘ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা’ বলে ডাকছে। একটু অবাকই হলাম। বাইরে বেড়িয়ে দেখি সত্যি মিষ্টি এসেছে। কেমন যেন এক অভিমানের সুরে বলল ‘কি হয়েছে তোমার? কেন আসছ না আমাদের বাড়ি? আমি কি করেছি? এ কি চেহারা করেছ? বাজে ছেলে’। ‘গাছে কাক আমি তো অবাক’ সত্যি এসব শুনে আমি অবাক। আমি যে তখন ভ্যান গখ্কে নিয়ে ব্যাস্ত ওকে বললাম সে কথা। দেওয়ালে যে দাগ হয়ে গেল, বুঝলাম এক্সটেরিওর ঠিক থাকলেও ভল্টে কিছু জমায় নি। সেদিন কেমন যেন লাগলো মিষ্টিকে। আসলে ভাল করে দেখিনি কখন ওর দিকে। সবুজ চাদরের মতো বিছানো ঘাসের ওপর ধূসর বাড়ির এক কোনে আমি আর আরেক কোনে দাড়িয়ে মিষ্টি। প্রচুর অক্সিজেন অথচ মানুষ দুজন। সেদিন তো চলে গেল ঠিকই কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্বস্তি তৈরি হল।
মিষ্টির বিষয়টা খুব ভাবার অবকাশ ছিলনা। তাই মাথা থেকে বেড়িয়ে গিয়েও থেকে গেল। চলমান ঘটমান জীবন এই ভাবেই চলল। বেশ কিছু মাস কেটে গেল। মিষ্টির মুখে ‘দাদা ক্ষ্যাপা এসে গেছে’ এটার বদল ঘটলো। বদলে হল ‘ক্ষ্যাপা একটা’ তাও ফিসফিস করে, কেমন যেন রাগ রাগ ভাব। যাইহোক, একদিন গিয়ে শুনলাম মিষ্টির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু মিষ্টির সে ছেলেকে পছন্দ নয়। কারণ, হবু বর ওর থেকে আঠারো বছরের বড়। বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগলো । বিয়ের ঠিক তিন চারদিন আগে হবে হয়তো, এক সন্ধ্যে বেলা মিষ্টি এলো আমাদের বাড়িতে আমার সাথে দেখা করতে। আমি ছিলাম না বাড়ি। বাড়ি এসে দেখলাম আমাদের বাড়ির আর ওদের বাড়ির সবাই মিলে মিষ্টিকে এই বিয়েতে রাজি করার জন্য বোঝাচ্ছে। তখন, বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে। খানিক বাদে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল মিষ্টিকে বোঝাবার। মিষ্টিকে নিয়ে আমি আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম, বোঝাবার জন্য। আমি আমার মতো করে ওকে বিয়েতে রাজি করার চেষ্টা চালাচ্ছি। এমন সময় দেখি মিষ্টি উঠে এসে আমার হাত চেপে ধরে বুকে মাথা রাখল। বলল ‘সত্যি করে বল অর্জুনদা, তুমি আমাকে গ্রহণ করতে পারো না? আমার যে তোমাকে ভাললাগে, কি করব বলো?, আমি যে আর কারুর সাথে সুখী হব না, আমি কি এতটাই দেখতে খারাপ?’। আবার আরেকবার ‘গাছে কাক আমি তো অবাক’। মিষ্টি দেখতে সত্যিই যে ভাল সেটা ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু এ সম্পর্ক না হবার কারণ শুধু মেধা আর বোধের অভাব তা বোঝাতে অক্ষম হলাম। কি ভাবে বোঝাই ভ্যান গখ্, ভ্যান চালক নন, আইজেনস্টাইন বিজ্ঞানী নন, আমি ক্রমশ অর্গানাইসড রিলিজন থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছি, কেন? উত্তর খুঁজছি আমি আসলে। এ বোঝানো সম্ভব নয় ওকে। সব শুনে বলেছিল ‘আমি এতো জানি না তোমার মতো, আমাকে শিখিয়ে দাও, দেখো আমি পারবো, যা বলবে আমি পড়ব, তোমার মনের মতো হবার জন্য, আমাকে ফেলে দিয়ো না, আমি যে বাঁচবো না তোকে ছাড়া অর্জুনদা’। আমার খারাপ লেগেছিল কিন্তু কিছু করারও ছিল না। বিয়ে হয়ে গেল মিষ্টির সেই ছেলের সাথে। বিয়েতে দারুণ মজা হয়েছিল। সিঁদুর পরে বেশ দেখাছিল মিষ্টিকে। বিয়ের রাতে সুর কাটল মিষ্টির এক কথায়, ‘আমি এখনও তোকে ভালবাসি আর বাসবও, একদিন ফিরে আসব তোমার কাছে যোগ্য হয়ে, তখন নেবে তো আমাকে?’। এর পর কেটে গেছে দু দুটো যুগ। মিষ্টির সাথে আমার আর এর মধ্যে দেখা হয়নি।
কয়েকদিন আগে ওদের বাড়ি গেছিলাম। দেখি মিষ্টিও এসেছে। ওর বড় ছেলে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আই আই টি তে পড়ছে। লক্ষ্য করলাম মিষ্টি আমার সাথে ঠিক করে কথা বলছে না। একটু ঘর খালি হতেই জিজ্ঞাসা করলো ‘তোমার বউ কি খুব বুদ্ধিমান গো? দেখতে ইচ্ছা করে, একদিন এনো দেখবো, জানো আমার বড়টা একদম তোমার মতো হয়েছে, লেখাপড়ায় খুব ভাল, ক্ষ্যাপা কিন্তু শান্ত, তোমার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেবে?’। আমি চুপ করে রইলাম আর ও বলতে থাকল ‘ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে তাই সারাদিন সময় পাই, বই পড়ি, চার্বাক যে কোন বিখ্যাত মানুষ নয় তাও জানি, এটা ভাবলেই হাসি পায় তোমার কথা মনে পরে, তোমাকে এখনও আগের মতো লাগে, এখনো ক্ষ্যাপা আছো?’। বললাম ‘না রে শান্ত হইনি এখনো, পাগলামি রয়ে গেছে’। মিষ্টির মুখটা বিষণ্ণ দেখালো, আমাকে হটাৎ বলল ‘তুমি ভাল আছো তো?’ বললাম ‘হ্যাঁ, দিব্য আছি’। ‘বাপের বাড়ি এলে এই সিঁড়ির সামনে দাঁড়ালে আজও মনে হয় এই তুমি এলে বলে, চলে যাও অর্জুনদা তুমি এখুনি, কেন এলি আমার সামনে, তোমার পায়ে পড়ছি চলে যাও’।
বেড়িয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকে…
স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।