ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক, ট্র্যাজিক হিরো হীরালাল সেন

hiralal sen photo

হীরালাল সেন – চিত্র উৎস – বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস – কালীশ মুখোপাধ্যায়। (পাবলিক ডোমেন – ইন্ডিয়া)

সূচনাটা কোথা থেকে হওয়া উচিত সেটিই বিষয়। প্রথম ভারতীয় ফিল্ম মেকার হীরালাল সেন? নাকি প্রথম ভারতীয় ডক্যুমেন্ট্রি ফিল্মমেকার হীরালাল সেন? তিনিই একাধারে ভারতীয় অ্যাড ফিল্ম, ওয়েডিং ফিল্ম এবং ভারতীয় পলিটিক্যাল ফিল্মেরও পথিকৃৎ। কোথাও একটা বিভ্রান্তি আছে বৈকি, যেখানে বিষয় ভারতীয় চলচ্চিত্র, সেখানে দাদাসাহেব ফালকে থেকেই সূচনা হবে তা তো ঐতিহাসিক ভাবে বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তাই বা হবে কি অর্থে? যে মানুষটা ১৯১১-১৯১২ সাল অর্থাৎ হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র জীবনের শেষের দিকেও চলচ্চিত্র নির্মাণে সেই অর্থে প্রবেশই করেন নি, এ লেখার সূচনা সেখান থেকেই বা কি ভাবে করা যায়। চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসের ফলশ্রুতি কার্যত দাদাসাহেব ফালকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক বলে অভিহিত হন । এ কথা বলতে দ্বিধা নেই হীরালাল সেন ব্রাত্য। এমনকি, তাঁর জীবন নিয়ে প্রচলিত নানা ভুলে ভরা তথ্য থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় তাঁর জীবনচর্চাও কতটা উপেক্ষিত।

বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে বাঙালী বা ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের ভূমিকা যে অপরিসীম, তা প্রমাণিত। বলা যেতেই পারে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ, এদের হাত ধরেই ‘বিশ্ব-চলচ্চিত্র’ মানচিত্রে বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র। সিনেমা নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা আজকের নতুন নয় এ তো নির্বাক চলচ্চিত্রের শুরুর দিক থেকেই। এর প্রতি বাঙালি তথা ভারতীয়দের আকর্ষণের শেকড় সন্ধান করলে সূত্র কিন্তু কলকাতাই। যিনি নিজের অজান্তেই এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি হলেন ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন। তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতি অবদান মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে। সহজ ভাষায় বললে হীরালাল সেনকে মানুষ ভুলেই গেছে। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সবাই দায়িত্ব নিয়ে তাঁর অবদান অস্বীকার করার জন্য যেন অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁকে ইতিহাসের পাতায় খুঁজতে গিয়ে বুঝেছি তাঁর ইতিহাস কতটা উপেক্ষিত। তথ্য বলছে, বর্তমান ভারতে যে ক’টি ফিল্ম ইন্সিটিউট আছে তাদের সিলেবাসে হীরালাল সেনের কোন স্থান নেই, আছেন দাদাসাহেব ফালকে। এই প্রসঙ্গে পরে আসব।

ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন ও হীরালাল সেনের সম্পর্ক – কেন দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয়কে দিয়ে এ লেখা শুরু করছি? হীরালাল সেনকে নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় যে বই থেকে, তা তাঁর পিসতুতো  দাদা রায়বাহাদুর ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের লেখা আত্মজীবনী মূলক বই ‘ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য’। যাইহোক, হীরালাল সেনের পিতা চন্দ্রমোহন সেনের ছোটবোন অর্থাৎ হীরালালের ছোটপিসি রূপলতার সাথে বিয়ে হয় ঈশ্বরচন্দ্র সেনের। ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও রূপলতার সন্তান হল দীনেশচন্দ্র সেন। একটা কথা বলে রাখা ভাল, ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয়ের এই বইতেও কিছুকিছু অসঙ্গতি আমার চোখে পড়েছে, মূলত সাল ও বয়স সংক্রান্ত তথ্য পরস্পর বিরোধী।

হীরালাল সেন ও রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি – হীরালাল সেনের জীবন সঠিক ভাবে লিপিবদ্ধ না হওয়ায় তা অনেক অংশই বেশ বিভ্রান্তিকর। কারণ খুঁজলে, বলাই যায় এমন একজন মানুষকে নিয়ে আমাদের উদাসীনতা অন্যতম। যে অর্থে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অংশ ও কর্মজীবনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা উচিৎ ছিল, বাস্তবিক তা হয়নি। অপরদিকে, হীরালাল সেন তিনি নিজেও তাঁর কাজের গুরুত্ব দিয়ে ডক্যুমেন্টেশন বা সংরক্ষণের কাজ করে রেখে যাননি। এটাও হয়তো ঠিক যে তিনি চলচ্চিত্র তৈরিতে এতোটাই নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন সেই কারণেই তিনি তাঁর কাজের সংরক্ষণের দিকে বেশ উদাসীন ছিলেন। তাছাড়া শেষজীবনে নানা কারণে জীবনের প্রতি তাঁর অনীহাও আরেকটি কারণ।

hiralal sen's company card

হীরালাল সেনের তোলা ছবির জন্য বিদেশ থেকে মুদ্রণ করে আনা বোর্ড পেপার – চিত্র উৎস – বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস – কালীশ মুখোপাধ্যায়। (পাবলিক ডোমেন – ইন্ডিয়া)

হীরালাল সেন বর্তমান বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে, সম্ভবত ১৮৬৮ বা ১৮৬৯ সাল নাগাদ এক সম্ভ্রান্ত ও বিত্তবান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, তাঁর পিতা চন্দ্রমোহন সেন, মাতা বিধুমুখী। তাঁর জীবনের প্রথম দিকটা কেটেছে বর্তমান বাংলাদেশে। এরপর, তাদের পরিবার কলকাতায়, স্টার থিয়েটার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটের একটি বাড়িতে উঠে আসে। আরেকটি মত অনুযায়ী প্রথমে ভবানীপুরে, আর তার অল্প কিছুদিন পর মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটের বাড়িতে উঠে আসেন। খুব অল্প বয়েসেই শুরু করেন ফটোগ্রাফি চর্চা। লেখাপড়ায় যে তাঁর খুব মন ছিলনা সে তাঁর দাদার স্মৃতিকথা থেকেই বোঝা যায়। কলকাতাতে এসে ভর্তি হন (খুব সম্ভবত) ডাফ কলেজে কিন্তু লেখাপড়ার থেকে বেশি আগ্রহ ছিল ফটোগ্রাফিতে। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফটোগ্রাফি নিয়ে মাতলেন এবং এটাই হল তাঁর একমাত্র নেশা এবং পরবর্তীকালে পেশা। প্রথম জীবনে, নিজের গ্রামে অর্থাৎ মানিকগঞ্জের বগজুরিতে তাঁর ভাই মতিলালের সাথে ‘Hiralal Sen & Brothers’ নামে ফটোগ্রাফির ব্যবসা শুরু করেন। তিনি যে খুবই ভালো ছবি তুলতেন, এমনকি তাঁর মতো ভালো ছবি সেই যুগে কেউই যে তুলতে পারতোনা, এ কথাও দীনেশচন্দ্র সেনের স্মৃতি কথাতে পাওয়া যায়। তাঁর কর্মজীবন বা ফিল্ম তৈরির কথায় আসার আগে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে দু এক কথা। তাঁর বিয়ে হয় হেমাঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে এবং তাদের চার কন্যা সন্তান এবং এক পুত্র সন্তান হয়। আরেকটি পুত্র সন্তান ছিল কিন্তু খুব অল্প বয়সেই সে মারা যায়। প্রথম সন্তান কন্যা সুরবালা, দ্বিতীয় সন্তান প্রফুল্লবালা, তৃতীয় প্রতিভা চতুর্থ সন্তান একমাত্র পুত্র বৈদ্যনাথ (জন্ম ১৯০২ সালে মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটের বাড়িতে) ও সর্বকনিষ্ঠ প্রমীলা দেবী।

Hemangini devi wife of film maker Hiralal sen

হীরালাল সেনের স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী

কলকাতায় চলচ্চিত্র আগমনের শুরুতেই হীরালালের আকর্ষণ তৈরি হয় এর প্রতি। দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর বইতে লিখছেন, হীরালালের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁর চলচ্চিত্র বা ফটোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল দাদার থেকেই। ছেলেবেলাতে গ্রামের বাড়িতে দীনেশ চন্দ্র সেন হ্যারিকেনের আলোয় শাড়ির ওপর ছায়া তৈরি করে নানা মজার খেলা দেখাতেন ভাইদের। সেই থেকেই হীরালালের ছবি তৈরির প্রতি আকর্ষণ। যাইহোক, সেই সময় স্টিভেনশন নামে এক সাহেব স্টার থিয়েটারে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতেন। এই চলচ্চিত্র তৈরি শেখার জন্য স্টিভেনশনকে গিয়ে ধরলেন হীরালাল সেন। এত সহজ হল না শেখা। তিনি হলেন সাহেব, তিনি কি আর এত সহজে এক নেটিভকে চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটি শিখিয়ে দেবেন? শেখালেন না। জেদি হীরালাল তখন নাছোঁড়বান্দা। তাঁকে যে ভেদ করতেই হবে চলচ্চিত্রের রহস্য। অবশেষে হার মানলেন স্টিভেনশন সাহেব। রাজি হলেন তাঁকে শেখাতে। কেন সাহেব রাজি হয়েছিলেন? এ নিয়েও অনেক মতবাদ আছে, অনেকে বলেন হীরালাল সেনের জেদের কাছে হার মেনেছিলেন, আবার অনেকের মত, তাঁকে অনেক টাকা দিয়েছিলেন হীরালাল। টাকা দেওয়াটাই বেশ গ্রহণযোগ্য যুক্তি বলে মনে হয়, কারণ দীনেশচন্দ্রের স্মৃতি কথা থেকেও পাওয়া যায়, এর জন্য হীরালাল প্রায় ১৪/১৫ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। অবশেষে, শুরু হল তাঁর শিক্ষা। এভাবেই চলচ্চিত্র পরাধীন ভারতের এক বাঙালি সন্তানের হাত ধরে আগামীর ইতিহাসে পা রাখল।  

তখন নিজের ক্যামেরা নেই, তাই ভরসা স্টিভেনশনের ক্যামেরা, তা দিয়েই ছোটছোট দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছেন। সেই যুগের অষ্টম আশ্চর্য ছিল এই বায়োস্কোপ, আর তাকেই নিজের হাতের মুঠোতে বন্দী করলেন এই বাঙালি। চলচ্চিত্রের জন্মের খুব বেশি সময় তখনও গড়ায়নি। সাল ১৮৯৮ এর ১০ই ডিসেম্বর, ইতিহাস রচনা করলেন তিনি । সেদিন স্টার থিয়েটারে ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ নাটকের সঙ্গে দেখান হল হীরালালের তোলা চলচ্চিত্র। এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলনা তাঁর জীবনে। স্টিভেনশন ফিরে গেলেন নিজের দেশে। ক্যামেরার অভাবে চলচ্চিত্রের কাজ গেল প্রায় বন্ধ হয়ে। খবর পেলেন, বটকৃষ্ণ পালের কাছে একটা মুভি ক্যামেরা আছে। চলচ্চিত্র তৈরির নেশায় মত্ত হীরালাল ছুটলেন বটকৃষ্ণ পালের কাছে। তার থেকে ধার চাইলেন ক্যামেরা এবং তিনি দিতে রাজি হয়ে গেলেন। বিনিময়ে কথা দিলেন তাঁর এডওয়ার্ড অ্যান্টি ম্যালেরিয়া টনিকের জন্য তৈরি করে দেবেন বিজ্ঞাপন। ১৮৯৮-৯৯ সাল হবে, এদিকে মায়ের কাছ থেকে একটা বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে লন্ডনের ‘জন্‌ বেঞ্চ কোম্পানি‘ থেকে আনালেন মুভি ক্যামেরা আর সঙ্গে প্রোজেক্টর মেশিন। ভাই মতিলাল আর দিদি সুন্দরী দেবীর ছেলে কুমারশঙ্কর গুপ্ত তথা ভোলানাথ গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি‘। ভাগ করে দিলেন সবার কাজ, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। ইতিহাস গড়লেন নিজের অজান্তে, ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র কোম্পানি হল এই ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’। অবশ্য, এই কোম্পানি রেজিস্ট্রি করা হয় ১৯০২ সালে। এই নতুন মুভি ক্যামেরা হাতে পাওয়ার পর বটকৃষ্ণ পালকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন তিনি, তৈরি করেছিলেন এডওয়ার্ড এর বিজ্ঞাপন। এটাই ভারতের সর্ব প্রথম অ্যাড ফিল্ম (সঠিক জানা নেই এর আগে পৃথিবীর অন্য কোন জায়গায় কোন অ্যাড ফিল্ম তৈরি হয়েছিল কিনা)। এরপরেও বানিয়েছেন আরও দুটি অ্যাড ফিল্ম। এখানে, আরেকজনের কথা নিশ্চয়ই বলতে হবে কারণ তিনি যুবক হীরালাল সেনকে একসময় যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। তিনি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাদ্রী অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ। ইনিই সর্বপ্রথম, যিনি নিজের ছাত্রদের চলচ্চিত্র দেখিয়ে পড়াবার জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্র আনিয়েছিলেন। সেই সময় চলচ্চিত্র দেখাবার জন্য লাইম লাইটের প্রয়োজন হত আর তার জন্য দরকার হত এক ধরনের রবারের ব্যাগ। এই রবারের ব্যাগের দাম ছিল আকাশ ছোঁয়া কারণ এই ব্যাগও বিদেশ থেকে আনাতে হত। একবার, হীরালাল সেনের রবারের ব্যাগ গেল ফুটো হয়ে। কলকাতায় এমন কোন জায়গা নেই যেখানে সে যায়নি এই ব্যাগ মেরামত করার জন্য কিন্তু কেউ পারেনি সারাই করতে। সর্বশেষে, এই ফাদার লাফোঁর চেষ্টায় সেই ব্যাগ সারানো হয়েছিল।

হীরালাল ১৯০০ সাল নাগাদ ক্যামেরা নিয়ে যান তার বগজুরি গ্রামে এবং সেখানে ভাইদের সাথে পুকুরে স্নান করার দৃশ্য গ্রহণ করে তৈরি করেন একটি ‘ট্রিক ছবি’। পরবর্তীকালে তিনি ‘কোটের খেলা‘ নামে আরেকটি ‘ট্রিক ছবি’ বানান। যা ক্লাসিক থিয়েটারে ‘চমকপ্রদ ম্যাজিক প্রদর্শনী’ বলে দেখানো হয়েছিল। তখন তাকে নিয়ে চারিদিকে জয়জয়কার। চারিদিকে ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ তখন চলচ্চিত্র দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, কখনো ক্লাসিক থিয়েটারে, স্টার থিয়েটারে, কার্জন পার্কে তাঁবু খাটিয়ে এবং আরও বহু জায়গায়। এরমধ্যে, ১৮৯৯ সাল নাগাদ বায়োস্কোপ দেখাবার জন্য ইলিসিয়াম বায়োস্কোপ কোম্পানির ব্যানারে ভাড়া নিয়েছিলেন মিনার্ভা থিয়েটার। হয়তো তাঁর মনের মধ্যে একটা স্থায়ী চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জায়গার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই থেকেই। ১৯০১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী, (কলকাতার ইতিহাস দিনলিপি – এন. বি. হাজরার মত অনুযায়ী দিনটি ৮ই ফেব্রুয়ারি) ক্লাসিক থিয়েটারে সাত খানা বিখ্যাত নাটকের খণ্ড দৃশ্য দেখিয়ে সারা কলকাতাকে তাক লাগিয়ে দিলো হীরালাল সেনের কোম্পানি। যেসব নাটকের খণ্ড দৃশ্য সেদিন দেখানো হয়েছিল সে নাটক গুলি হল ‘আলিবাবা’, ‘বুদ্ধ’, ‘ভ্রমর’, ‘সরলা’, ‘দোললীলা’, ‘হরিরাজ’ এবং ‘সীতারাম’। এগুলো সবকটাই ছিল নাটকের দৃশ্যের চলচ্চিত্রকরণ কিন্তু এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে এটাই ছিল বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা। এবার তিনি মনোনিয়োগ করলেন আরও উন্নততর চলচ্চিত্র নির্মাণে, বানালেন ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’। এটাও হয়তো চিত্রায়িত নাটক কিন্তু এর ইনডোর শুটিং হয়েছিল ক্লাসিক থিয়েটারে আর আউটডোর শুটিং হয়েছিল বটকৃষ্ণ পালের বাগান বাড়িতে সূর্যের আলোতে। এই ছবিতে ক্লোজআপ, টিল্ট, ও প্যানিং ইত্যাদি কলাকৌশলের ব্যাবহার করা হয়েছিল। তাঁর নির্মিত এই চলচ্চিত্রের উন্নতির কারণ হয়তো লুকিয়ে ছিল প্যাথে কোম্পানির কলকাতা আগমনের মধ্যে। সম্ভবত, ১৯০০ সাল নাগাদ ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানি বেশ কয়েকজন ক্যামেরাম্যানকে কলকাতাতে পাঠিয়েছিল, সেই সময় হীরালাল তাদের দলে ভিড়ে যান। সেখানেই হাতে কলমে তিনি চলচ্চিত্রের অনেক খুঁটিনাটি শিখে ফেলেন। যার প্রতিফলন হয়তো ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর‘ নির্মাণে দেখা গিয়েছিল। ১৯০৪ সালের ২৩শে জানুয়ারীতে এই ছবির প্রথম প্রদর্শন করা হয় ক্লাসিক থিয়েটারে। এরপরেও তিনি বানিয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘ইয়ং ভেগাবন্ড‘ ১৯০৯ সালে, ১৯০৪ সালে বানিয়েছিলেন আরও দু’টি ছবি একটি শকুন্তলা অবলম্বনে ‘ফিশারম্যান‘, ও আরেকটি ‘পিকপকেট‘। এখানেই থেমে ছিলনা হীরালালের ইতিহাস গড়ার রথ। সাল ১৯০৪, জানুয়ারী মাস, তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন সরকারি ভাবে ঘোষণা করলেন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা। এ খবর প্রকাশ হবার পর দেশ জুড়ে শুরু হল প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দিকেদিকে প্রতিবাদ। তখনও, গুরুদেব ‘আমার সোনার বাংলা’ এই গানের জন্য কলম ধরেননি। কিন্তু হীরালাল তখনও আঁকড়ে ধরে আছেন তাঁর পরম প্রিয় মুভি ক্যামেরা। যা দিয়ে তিনি গড়ে গেলেন আরেক ইতিহাস কিন্তু তা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেলেও তিনি তাঁর উপযুক্ত সন্মান পেলেন না। কলকাতার ডালহৌসিতে চলছে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল। মহামিছিল, তাই প্রচুর মানুষের ভিড় আর সেখানে বক্তাদের মধ্যে রয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। হীরালাল সেন তাঁর ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে ফিক্স করলেন ট্রেজারি বিল্ডিং-এর মাথায় (এটা কে কি এরিয়াল শট বলা যেতে পারে?), যাতে ছবি তুললেও ভিড়ের পেছনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে বক্তা হিসেবে তাঁর ক্যামেরাতে ধরা যায়। তুলে ফেললেন সে ছবি। এটাই ছিল ভারতের সর্বপ্রথম পলিটিক্যাল ডক্যুমেন্ট্রি ফিল্ম। সত্যি জানা নেই, এর আগে পৃথিবীর অন্যও কোন প্রান্তে পলিটিক্যাল ডক্যুমেন্ট্রি ফিল্ম তৈরি হয়েছিল কিনা। তাঁর চলচ্চিত্র কথার ইতি এখানেই টানতে হবে কারণ সে আরও লম্বা ইতিহাস। বরং কেন তিনি ট্র্যাজিক হিরো এবং ব্রাত্য থেকে গেলেন সেই দিকটাই এবার ধরার চেষ্টা করি।

তখন তাঁকে নিয়ে চারিদিকে জয়জয়কার। এই সময় তিনি দু’হাতে রোজগার করেছেন আর পেয়েছেন অনেক পুরুস্কার। অনেক রাজা মহারাজার থেকেও  পেয়েছেন পুরুস্কার। ১৯০১ সালে মোহন মেলায় পান স্বর্ণপদক, ১৯০২ সালের ২ই ফেব্রুয়ারীতে নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্র দেখিয়ে পান স্বর্ণপদক।

খারাপ সময় আর অসৎসঙ্গ কি যে মারাত্মক হতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হীরালাল সেনের জীবনের শেষ কিছু বছর। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল, দীনেশ চন্দ্র সেন এক জায়গায় লিখছেন যার অর্থ এই  ‘হীরালালের মতো স্বচ্ছ চরিত্রের ছেলে থিয়েটারের বধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে বিপথে গেছিল’।

Hiralal4 ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য - দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ৫৮ ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ৫৮

‘Hiralal Sen & Brothers’ কোম্পানির ম্যানেজার ছিল রামলাল দত্ত। নামে রাম থাকলেও সে ছিল প্রতারক। এই রামলাল দত্তকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে ‘শো হাউস’ নামে (বর্তমানে গণেশ টকিজ) এক চিত্রগৃহের উদ্বোধন করলেন। এই শুরু হল বিপর্যয়। প্রথমে হারালেন, বন্ধু অমরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়কে, তাঁর মৃত্যু সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি হীরালাল সেনের জীবনে। আরেক দিকে কুসুমকুমারী মামলা করলেন ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ এর লাভ্যাংশের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। প্রচুর টাকার খেসারত দিতে হয়েছিল এরজন্যে। তাঁর সখের শো হাউস ততদিনে ঠকিয়ে নিজের নামে করে নিয়েছে প্রতারক রামলাল দত্ত। পরে অবশ্য মতিলাল সেন এই শো হাউস লিজে নিয়েছিলেন এবং নতুন করে নাম রেখেছিলেন ‘সিনেমা সাঁলো’। কিন্তু, এতদিনে হীরালাল সর্বস্ব খুঁইয়ে পথে বসেছেন। খারাপ সময় এলে চারদিক দিয়ে আসে। পারিবারিক বিবাদে ভাই মতিলালও দাদার সঙ্গ ত্যাগ করলেন। দুইভাই আলাদা হয়ে গেলেন। এমনকি ভাগ হয়ে গেল ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ও। হীরালাল সেন করলেন ‘এইচ. এল. সেন রয়্যাল বায়োস্কোপ’ এবং মতিলাল করলেন ‘এম. এল. সেন রয়্যাল বায়োস্কোপ’ কোম্পানি এবং পৃথক ভাবে পরিচালনা করতে লাগলেন। তখন তাদের সম্পূর্ণ পরিবার থাকতো ৩১, হরিতকী বাগানের বাড়িতে। হীরালাল সেন সেখান থেকে চলে এলেন  রামপ্রসাদ উদ্যানের পাশে ১৮ নম্বর ব্ল্যাকি স্কোয়ারের বাড়িতে আর মতিলাল গেলেন রায়বাগানের বাড়িতে যার নিচের তলায় ছিল রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির গুদাম।

এখানেই থেমে থাকেনি হীরালালের ভাগ্য বিপর্যয়। এর মধ্যে ভুগছেন দুরারোগ্য ক্যান্সারে। অসহায়, সহায় সম্বলহীন অবস্থা, হাতে চিকিৎসার পয়সাটুকুও নেই। প্রাণের চেয়েও প্রিয় ক্যামেরা দুটি আংটা মল্লিক তথা পান্না মল্লিকের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন। অসুস্থতার জন্য শরীর চলেনা তবুও পেট তো চালাতে হবে। তাই চাকরি নিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নারায়ণচন্দ্র বসাকের ‘লন্ডন বায়োস্কোপ’ কোম্পানিতে। শরীর ক্রমশ ভেঙ্গে পড়তে লাগল হীরালালের। অচল সংসারকে সচল রাখা আর নিজের চিকিৎসার খরচ বহন করার জন্য করতে শুরু করলেন বিভিন্ন কাজ। বড়লোকদের ফটোগ্রাফ থেকে ছবি এঁকে দেওয়া, ভারতীয় দেবদেবীদের রঙ্গিন ছবি আঁকা। এরকম অনেকরকম কাজ করেছেন ঐ অসুস্থ শরীরে। জীবনের চিত্রনাট্যে আরও কিছু অপেক্ষা করছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেনের জন্য। ২৪শে অক্টোবর ১৯১৭, দুর্গা পুজোর মহানবমীর দিন আগুণ লাগল রায়বাগানের মতিলাল সেনের বাড়িতে। সেই ভয়াভয় অগ্নিকান্ডে মারা গেল মতিলাল সেনের বড় কন্যা অর্থাৎ জ্ঞানদাশঙ্কর গুপ্তের স্ত্রী অমিয়বালা আর তার সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেল হীরালাল সেনের সারাজীবনের পরিশ্রমের এক বৃহৎ অংশ। যদিও বিভিন্ন বক্তব্য অনুযায়ী সম্পূর্ণ অংশই পুড়ে গেছিলো কিন্তু তথ্য বলছে ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ এর সামান্য অংশ অক্ষতই ছিল। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এই অপূরণীয় ক্ষতি নীরবে আর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল। ২৯শে অক্টোবর ১৯১৭ সালে (দেখুন – ‘হীরালাল সেন সম্পর্কে কিছু চলতি ভুল তথ্য সম্পর্কে আলোচনা’), নীরবে চলে গেলেন ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক, ট্র্যাজিক হিরো হীরালাল সেন। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক বলে থেমে যাওয়া অন্যায় হবে, তিনি চলচ্চিত্র বিজ্ঞানীও ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দিন ব্ল্যাকি স্কোয়ারের বাড়িতে তাঁর নিজের পরিবারের লোক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন তাঁর বন্ধু, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু তাঁর ভাই মতিলাল সেন অনুপস্থিত ছিলেন। সেই সময় তাদের বৃদ্ধ পিতামাতা জীবিত ছিলেন, থাকতেন ডালিমতলায় এক ভাড়া বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পূর্ণ পরিবারের অর্থাৎ স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী এবং তাদের চার কন্যা সুরবালা, প্রফুল্লবালা, প্রতিভা ও প্রমীলা এবং একমাত্র পুত্র সন্তান বৈদ্যনাথের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর ভাই দেবকীলাল। 

হীরালাল সেনের চলচ্চিত্রের তালিকা – সম্পূর্ণ তালিকা এই কথাটির ব্যবহার করলাম না। তার কারণ, তাঁর সর্বমোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা নিয়ে সব চলচ্চিত্র গবেষক এক মত প্রকাশ করেননি। কোথাও সংখ্যার দিক থেকে বা কোথাও চলচ্চিত্রের ধরনের দিক থেকে সংখ্যার তারতম্য রয়েছে। যেমন প্রণব কুমার বিশ্বাসের মত অনুযায়ী তাঁর সর্বমোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২০, আবার জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, মীজানুর রহমান বা অনুপম হায়াৎ প্রমুখ ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া, তাঁকে নিয়ে আগামীতে আরও রিসার্চ হওয়া দরকার এবং সেখান থেকে আরও নতুন তথ্য হয়তো পাওয়া যেতে পারে। যাইহোক, প্রয়াত কালীশ মুখোপাধ্যায়ের তৈরি তালিকাটি অধিক গ্রহণযোগ্য তাই সেটিকেই অনুসরণের ফল এই তালিকা।

List of Films by Hiralal Sen

হীরালাল সেনের বংশ তালিকা এবং পরিবারের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব – সেই অর্থে হীরালাল সেনের বংশ তালিকা নেই বললেই চলে। যার ফলে সঠিক ভাবে পরস্পরের সম্পর্ক গুলি বুঝতে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। তাই,  টুকরো টুকরো তথ্য বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করে হীরালাল সেনের একটি বংশ তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। এখানে আরেকটি প্রাসঙ্গিক কথা, তাঁর বংশের বা তাঁর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আছেন তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করার মধ্যে দিয়ে বুঝে নেওয়া, যে তাঁর বংশ মর্যাদা এবং পরবর্তীকালে হীরালাল সেনের কর্মকাণ্ডের প্রভাব তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাংলা সিনেমার বিখ্যাত অভিনেত্রী জ্যোৎস্না গুপ্ত হলেন কুমারশঙ্কর গুপ্তের মেয়ে। কুমারশঙ্কর গুপ্ত অর্থাৎ ভোলা হল হীরালাল সেনের ভাগ্নে তথা হীরাপ্রভা দেবীর ছেলে। হীরালাল সেনের ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ এর ফিল্ম অপারেটর ছিলেন। সেই অর্থে ভারতের প্রথম ফিল্ম অপারেটর কিন্তু কুমারশঙ্কর গুপ্ত

হীরালাল সেনের বোন সরোজিনী দেবীর কন্যা পদ্মা দেবীর বিয়ে হয় স্বনামধন্য দেশনেতা কিরনশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। পদ্মা দেবীর নাম অনুসারে দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে রয়েছে পদ্মশ্রী সিনেমা হল, এক সময় এই হলের অন্যতম অংশীদার তাঁরাই ছিলেন।

আমাদের প্রিয় স্বনামধন্য অভিনেত্রী প্রয়াত সুচিত্রা সেনের খুড়শ্বাশুরি হলেন হীরালাল সেনের তৃতীয় কন্যা প্রতিভা দেবী। আরেকটু পরিষ্কার করে উল্লেখ করলে, হীরালাল সেনের মেয়ে তথি অর্থাৎ প্রতিভা সেনের বিয়ে হয়েছিল নরনাথ সেনের সঙ্গে। আর এই নরনাথ সেনের ভাই আদিনাথ সেন হলেন প্রয়াত সুচিত্রা সেনের শ্বশুর।

তাঁর পিসতুতো দাদা রায়বাহাদুর ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের কথা নতুন করে বলার কিছুই নেই, তিনি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার, গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ। দেবকীলাল সেনের পুত্র দিলীপ সেন ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। উত্তম কুমারের আলোছায়া প্রোডাকশানের গোড়াপত্তনে ওনার বিশেষ ভূমিকা ছিল। মতিলাল সেনের পুত্র জগন্নাথ সেন ও বলরাম সেনের খড়দহের শ্রীমা টকিজ (অধুনা লুপ্ত) নামে একটি সিনেমা হল ছিল। তাছাড়া, এনারাই ‘গোকুল রয়্যাল বায়স্কোপ‘ এর স্বত্বাধিকারী ছিলেন।

Hiralal Sen's Family Tree 1

হীরালাল সেনের বংশ তালিকা

Hiralal Sen's Family Tree 2

হীরালাল ও হেমাঙ্গিনী সেনের বংশ তালিকা

Hiralal Sen's Family Tree 3

মতিলাল ও শৈলবালা সেনের এবং দেবকীলাল ও অরুন্ধতী দেবীর বংশ তালিকা

চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ভিস্যুয়াল আর্টসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী মাধ্যম হল চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের ইতিহাস ফিরে দেখার কারণ মূলত, ভারত তথা সমগ্র চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি হীরালাল সেনের যে অবদান তা সঠিক ভাবে বুঝে নেবার জন্য। তাছাড়া, শুরুর দিন গুলি সম্পর্কে ধারনা থাকলে বুঝতে সুবিদা হবে কোন সময় এবং কোন পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে তিনি ইতিহাস রচনা করে গেছেন। যাইহোক, বিশ্বে চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে যাকে সবাই মেনে নিয়েছেন তিনি হলেন টমাস আলভা এডিসন। তিনি ১৮৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার ব্রডওয়েতে তাঁরই আবিষ্কৃত যন্ত্র ‘কিনেটোস্কোপ’ প্রথম মানুষের দরবারে নিয়ে আসেন। কিন্তু, অনেকের মতে ১৮৮৯ সালে ডিকসান আমেরিকার প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনকারী। এ কথা বলা হলেও, ডিকসনকে আমেরিকার চলচ্চিত্রের জনক বা বিশ্বের চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে কেউই স্বীকার করেননি। এরপর, চলচ্চিত্র বিজ্ঞানী টমাস আরমট, এডিসনের তোলা ছবিগুলি নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা শুরু করেন এবং অবশেষে সেই ছবিগুলির ছায়া একটি পর্দায় ফেলতে সমর্থ হলেন। তৈরি করলেন নতুন যন্ত্র ‘ভিটাস্কোপ’। ফলে, একসঙ্গে অনেকে মিলে ছবি দেখার নতুন দিগন্ত খুলে গেল। এই শুরু হল চলচ্চিত্রের যাত্রা মানবচিত্তকে জয় করার।

এ আগুণ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো বিশ্বের নানা দেশে, আমেরিকা থেকে লন্ডন, ফ্রান্স, জার্মানি এমনকি পরাধীন ভারতেও। সেই সময় অনেক চলচ্চিত্র বিজ্ঞানী ও স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের অবদান অনস্বীকার্য। কয়েকজনের নাম এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করার প্রয়োজন অন্যথা অন্যায় হবে। ইংল্যান্ডের আর্মাড মে ব্রিজ, লুমিয়ের ব্রাদার্স, রোনাল্ড এঁদের হাত ধরে চলচ্চিত্র সাধারণের কাছে এসে পৌঁছেছিল। এঁদের পর চলচ্চিত্রের ইতিহাস যাদের দ্বারা আরও গৌরবান্বিত হয়েছে তাঁরা হলেন গ্যাস, ফ্রান্সের চার্লস প্যাথে, জার্মানির মেলটারা প্রমুখ।

চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা নিরন্তর চলতে থাকলো কিন্তু এরই মধ্যে ফ্রান্সের অগাস্ট লুমিয়েরলুই এই দুই ভাই সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করলেন। শুরু হল চলচ্চিত্রের বাণিজ্য অভিমুখে যাত্রা। এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটলো প্যারিসের ভদেভিল ক্যাপুচিনের গ্র্যান্ড কাফেতে ১৮৯৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর। ঐ দিনই, অগাস্ট লুমিয়ের ও লুই এই দুই ভাই প্রথম ছায়া চিত্র দেখালেন। টিকিটের দাম ছিল মাথাপিছু ১ ফ্রাঁ আর সিনেমার নাম ছিল ‘স্যালোন দ্য ইন্ডেস’।

ভারতে তথা কলকাতায় চলচ্চিত্রের আগমন – ব্যবসার জন্য ভাল দেশ যে ভারতবর্ষ, এ মন্ত্র ততদিনে বিশ্ববাসির কাছে বেশ পরিষ্কার। তাই, ১৮৯৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বরের পর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি পরাধীন ভারতবর্ষকে। সেই সময় ভারতের রাজধানী কলকাতা হলেও লুমিয়ের ব্রাদার্সের এজেন্ট মরিস সেস্তিয়ের বোম্বাইকে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য বেছে নিলেন। ১৮৯৬ সালের ৭ই জুলাই বম্বের এসপ্ল্যানেড ম্যানসনের ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র দেখাবার ব্যাবস্থা করলেন। এই শুরু হল ভারতে সিনেমার শিল্প হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। বাকিটা ইতিহাস।

সেই সময়, জন্ম নিয়েছিল এক নতুন পেশার, সিনেমার ফেরিওয়ালা। তাদের কাজ ছিল ঘুরে ঘুরে সিনেমা দেখানো। কলকাতাকে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি, সিনেমার ফেরিওয়ালা ভেনসন  সেই বছরেই অর্থাৎ ১৮৯৬ সালে অক্টোবর মাসে কলকাতার মানুষকে তাক লাগিয়ে দিলেন চলমান ছবি দেখিয়ে। এই সময় ইংরেজ সিনেমার ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে এই শহরে। ঠিক এই সময় দাঁড়িয়ে এই শহরের এক জেদি বাঙালী যুবক প্রস্তুতি নিচ্ছে চলচ্চিত্র জগতে নিজের অবদান রাখার জন্য। আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা তো দেবেই সঙ্গে নতুন ইতিহাসও রচনা করবে সে। হীরালাল সেন নিজের অজান্তেই হয়তো গড়ে দিয়ে গেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ভীত ও ভবিষ্যৎ। ভেবে দেখার বিষয় কোন সময় দাঁড়িয়ে হীরালাল সেন তাঁর অবদান রেখে গেছেন।

হীরালাল সেন সম্পর্কে কিছু চলতি ভুল তথ্য সম্পর্কে আলোচনা

জন্ম সাল –  হীরালাল সেনের জন্ম সাল ও তারিখ হিসেবে সর্বত্র ২রা অগাস্ট ১৮৬৬ সালের উল্লেখ পাওয়া যায়। যদি তাঁর জন্ম ২রা অগাস্ট ১৮৬৬ সালে হয়ে থাকে তাহলে তাঁর দাদা দীনেশচন্দ্র সেনের জন্ম ৩রা নভেম্বর ১৮৬৬ সালে কি করে হয়?

দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, তাঁর জন্ম ১৮৬৭ সালে এবং পরবর্তীতে লিখেছেন হীরালাল সেন তাঁর থেকে ২ বছরের ছোট। তাঁর বইতে তাঁর জন্ম সাল উল্লেখ করলেও কোন তারিখের উল্লেখ করেননি। আর যাইহোক, হীরালাল সেন দীনেশচন্দ্রের থেকে ২ বছরের ছোট হলে তাঁর জন্ম ১৮৬৬ সালে হতে পারেনা। দীনেশচন্দ্র সেনের মত মানুষ যখন তাঁর পরিবারের কথা লিখছেন তখন সেখানে তিনি এত বড় ভুল লিখবেন ভাবনাটি অযৌক্তিক। উদ্রিতি হিসেবে বইটির একটি অংশ দেওয়া আছে এখানে, সেটি দ্বিতীয় সংস্করণ তাই প্রথম সংস্করণে কোন ভুল ভ্রান্তি থেকে থাকলেও তা  দ্বিতীয় সংস্করণে অনেক অংশেই সংশোধিত হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু, এটা ঠিক যে তাঁর জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে। হিসেব করলে, তাঁর জন্ম খুব সম্ভবত ১৮৬৮ বা ১৮৬৯ সালে কিন্তু ১৮৬৬ সালে নয়।

Hiralal Sen 3 ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য - দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ২৯ ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ২৯

Hiralal Sen 2

ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ৫৮

জমিদার – জমিদার বা বড়লোক এই দুই আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে বলে মনে হয়। অন্যের ভিন্ন মত থাকতেই পারে। হীরালাল সেনের বাড়ির অবস্থা প্রথম দিকে খুবই ভালো ছিল এটা আমরা দীনেশচন্দ্রের লেখা থেকেই পাই। নানা কারণে হীরালালের পিতার জীবিত কালেই তাদের প্রচুর দেনা হয়ে যায়। সে কথায় পরে আসা যাবে। যাইহোক, তাদের পরিবার যে বড়লোক ছিল, একথা পাওয়া যায় দীনেশচন্দ্রের বইতে। কিন্তু পরবর্তীকালে লেখা হীরালাল সেনকে নিয়ে সব বইতেই বড়লোক, জমিদার পরিবারে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁদের  জমিজমা, গাছ, ফুলের বাগান, পুকুর, বাড়ি সবই ছিল এছাড়া চন্দ্রমোহন সেনের আইনের পেশা থেকে খুব সামান্য হলেও রোজগার ছিল। এই রোজগার নিয়েও নানা মত আছে। তাদের পরিবারের আরেকজন শ্রীজ্যোতিষ গুপ্ত মহাশয়ের মতে, চন্দ্রমোহন সেন কোনদিনই ওকালতি করেননি। এই আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে কি জমিদার আখ্যা দেয়া যায়, না কি অবস্থাপন্ন বা সচ্ছল পরিবার বলে সম্বোধন করাই ভাল। আরেকটি কারণ আছে তা হল হীরালাল সেনকে নিয়ে নব্বই দশকের আগে কোন লেখাতেই তাদের পরিবারকে জমিদার আখ্যা দেওয়া হয়নি, অন্তত আমি খুঁজে পাইনি। বরং দীনেশচন্দ্রের বইতে বড়লোক কথাটির উল্লেখ আছে।

Hiralal Sen 1

ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ৯৮

মৃত্যু দিন – হীরালাল সেনের মৃত্যু দিন নিয়েও বেশ বিভ্রান্তি রয়েছে। বলা হয়, ২৪শে অক্টোবর ১৯১৭ সালে ঐ অগ্নিকান্ডের দুইদিন পরে অর্থাৎ ২৬শে অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। ২৪শে অক্টোবর ছিল দুর্গাপুজোর নবমী, এর দুইদিন অর্থাৎ ২৬শে অক্টোবর ছিল একাদশীর দিন (সেই সময়ের পঞ্জিকা দেখলেই পাওয়া যাবে) এবং এই দিনটি তাঁর মৃত্যু দিন হিসেবে ধরে নেওয়াও খানিক ভুল। ‘কলকাতার ইতিহাসে’ বইতে এন. বি. হাজরা মহাশয় খবরে প্রকাশিত তথ্য থেকে তার মৃত্যু দিন হিসেবে ২৯শে অক্টোবর লিখেছেন। চলচ্চিত্র গবেষক রবিন বন্দ্যোপাধ্যায় ওনার বইতে ২৮শে অক্টোবর লিখে গেছেন।  মনে হয়েছে দু’দিন কথাটি রূপক অর্থে অর্থাৎ বাঙালিরা যেমন বলে থাকে এত বড় দুর্ঘটনার পর ‘দুদিন যেতে না যেতেই ওনার মৃত্যু হয়েছে’। ঠিক সেই অর্থে, এর থেকেই ওনার মৃত্যু দিন ২৪+২ অর্থাৎ ২৬ তারিখ হয়ে গেছে। এই যুক্তিতেই মনে হয়, একজন কলকাতা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক আর আরেকজন চলচ্চিত্র গবেষকের কাছাকাছি একই তথ্য পরিবেশনা, অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। আর গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে বলতে গেলে, তখনকার খবরে প্রকাশিত তথ্য থেকে লেখা ২৯শে অক্টোবর তারিখটি সঠিক বলে মনে হয়েছে।

অগ্নিকান্ডে সব পুড়ে ছাই – এখানেও একটি তথ্যগত ভুল রয়েছে, যে ২৪শে অক্টোবর ১৯১৭ সালে রায়বাগানের বাড়িতে অগ্নিকান্ডে হীরালাল সেনের সব কিছু পুড়ে গিয়েছিল। হীরালাল সেনের সমস্ত তোলা ছবি ঐ অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায়নি। তাঁর পুত্র বৈদ্যনাথ সেনের কাছে হীরালাল সেনের তোলা অবশিষ্ট কিছু ছবি, ক্যামেরা, লেন্স, ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ছিল। এই সমস্ত কিছু বৈদ্যনাথ সেন শরৎলতা দেবীর কাছে গচ্ছিত রাখেন। শরৎলতা দেবী হলেন হীরালাল সেনের কাকা মোহন সেনের মেয়ে। খুব দুঃখের বিষয় যে পরবর্তীকালে এ সমস্ত কিছুই নষ্ট হয়ে যায় এবং বৈদ্যনাথ সেন সেখান থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। ইথারে আগুণ লেগে নষ্ট হয়ে যাওয়া, সত্যিই খুব দুঃখজনক কিন্তু অবশিষ্ট অংশটুকু যা পরবর্তীকালে শরৎলতা দেবীর থেকে নষ্ট হয় সেটি ক্ষমার অযোগ্য। ঐ অগ্নিকান্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে তা হয়তো বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ ছিল।

কলকাতায় হীরালাল সেনের বাসস্থান – হীরালাল সেন কলকাতায় আসার পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে যে বাড়িতে থেকেছেন সেই বাড়ি গুলি চিহ্নিত করনের প্রয়জনিয়তা থেকে এই প্রচেষ্টা। বাস্তবিক, একটি বা খুব বড় জোর দু’টি বাড়ি ছাড়া আর অন্য বাড়ি গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ পাইনি। যতটুকু জানা যায়, কলকাতায় আসার পর থেকে মোট চারটে বাড়িতে হীরালাল সেনের স্মৃতি জরিয়ে আছে। এছাড়াও, আরেকটি বাড়ির কথা শোনা যায় সেটি দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে শাঁখারিটোলায় ছিল কিন্তু সে বাড়ি অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া বা চিহ্নিত করা যায়নি। আশা রাখি সে বাড়ির খোঁজ আগামী দিনে পাওয়া যাবে।

১) মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটের বাড়ি – হীরালাল সেনের পরিবার বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে খুবসম্ভবত, প্রথম ভবানীপুরে এবং তার কিছুদিন পরেই যে বাড়িতে বসবাস শুরু করেন সেটি উত্তর কলকাতার ৮৫/২ নম্বর মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটে। কালীশ বাবুর মতে এই বাড়ি তৈরি করেছিল সেন পরিবারই এবং পরবর্তীকালে ডঃ ডি এম চ্যাটার্জি এই বাড়ি তাদের থেকে কিনে নেয়। কিন্তু, বর্তমানে এই বাড়ি যাদের মালিকানাধীন তাদের মধ্যে এক শরীক জয়ব্রত চক্রবর্তীর মতে, এই বাড়ি ১৯৬০-৬৫ সাল নাগাদ তাদের পিতা প্রয়াত বিমল কুমার চক্রবর্তী ঠাকুর পরিবারের থেকে কিনেছিলেন এবং বর্তমান শরীক ওনারই চার সন্তান। জয়ব্রত বাবুর মত অনুযায়ী এই বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন হীরালাল সেনের পরিবার। এই সূত্র ধরে, যদি সত্যিই হীরালাল সেনের পরিবার জমিদার হয়ে থাকেন তাহলে কেন তাঁর পরিবার বারবার ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন। ভবানীপুরের বাড়ি যদি নিজেদের হয়ে থাকেও, তাহলে সেই বাড়ি বিক্রি করে এই বাড়িতে উঠে আসার কি কারণ ছিল?

আরেকটি মতে, মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটের এই বাড়ি বিক্রি করে নাকি ঐ মসজিদ বাড়ি স্ট্রীটেই আরেকটি ভাড়া বাড়িতে উঠে যায় তাঁর পরিবার, তারপর হরিতকী বাগানের বাড়ি, রায়বাগানের বাড়ি, ডালিমতলার বাড়ি, শিকদার বাগানের বাড়ি, সবকটিই ভাড়া বাড়ি। যদিও বা প্রাথমিক ভাবে ভাড়াতে থাকলেন, তবে কেন তাঁর পরিবার জমিদার হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী কালে নিজেদের বাড়ি তৈরি করতে পারলেন না। যদি পরবর্তীকালে বাড়ি কিনে বা তৈরি করেও থাকেন এই কলকাতাতে তাহলে সেটি কোন বাড়ি বা কোন কোন বাড়ি গুলি? তবে সে বাড়ির গুলির চিহ্নিতকরন প্রয়োজন। এই বাড়ি স্টার থিয়েটারের খুব কাছেই তাই অনুমান করা যায় হীরালাল সেনের জীবনে এই স্টার থিয়েটারের প্রভাব হয়তো ছিল। আরেকটি কথা, এই বাড়িতেই অসুস্থ হয়ে দীনেশ চন্দ্র সেন বেশ কিছুদিন ছিলেন এই বাড়ির দোতলার হল ঘরে এবং সেই সময় অনেক বিখ্যাত মানুষের পদধূলি পড়েছে এই বাড়িতে। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী প্রায়ই আসতেন অসুস্থ দীনেশচন্দ্রকে দেখতে, এছাড়া আসতেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নগেন্দ্রনাথ বসু, সুরেশ সমাজপতি প্রমুখ ব্যাক্তিত্ব। একথা দীনেশ চন্দ্র সেনের স্মৃতিকথা থেকেই জানা যায়। হিরালাল ও দীনেশচন্দ্র সেনের স্মৃতিবিজড়িত ঐ মারবেল দেয়া দোতলার হল ঘরটি দেখার বড্ড ইচ্ছা ছিল। এই বিষয় তাদেরকে অনেকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ঐ হল ঘর তো দূরের কথা তারা আমাকে তাদের বাড়ির চৌকাঠ অব্দি পেড়োতে দেয়নি।

film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Masjid Bari Street
film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Masjid Bari Street film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Masjid Bari Street

২) হরিতকী বাগান লেনের বাড়ি – হেদুয়ার মোড় থেকে সোজা গেলে স্কটিশ চার্চ কলেজের রাস্তাকে ডানদিকে রেখে খানিকটা এগিয়ে গেলে ডানদিকেই পরবে হরিতকী বাগান লেন। এই রাস্তাই গিয়ে উঠছে মানিকতলা শিব মন্দিরের আগে। ৩১, হরিতকী বাগান লেনের এই বাড়িতেই থাকতেন হীরালাল ও মতিলাল সেন। এই বাড়িতেই থাকাকালীন দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। হীরালাল সেন উঠে যান রামপ্রসাদ উদ্যানের পাশে ১৮ নম্বর ব্ল্যাকি স্কোয়ারে আর মতিলাল এই বাড়ি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দুরে হেদুয়ার পাশে রায়বাগানের বাড়িতে। যে বাড়িতে ছিল ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ এর গুদাম। এই বাড়িতে বর্তমানে কেউ থাকেনা। আর কিছুদিন বাদেই হয়তো বিপজ্জনক বাড়ি ঘোষণা হবে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সামনের যে অংশটি সামান্য সারাই করা হয়েছে তা হয়েছে একটি সিনেমার শুটিং-এর জন্য।

film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Haritaki Bagan Lane film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Haritaki Bagan Lane
film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Haritaki Bagan Lane film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Haritaki Bagan Lane

৩) ব্ল্যাকি স্কোয়ারের বাড়ি – দুই ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ (পারিবারিক বিরোধ) হওয়ায় ১৯১৩ সালে হীরালাল সেন তার স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী ও সন্তানদের নিয়ে উঠে আসেন ১৮ নম্বর ব্ল্যাকি স্কোয়ারের এই বাড়িতে। তখন, এই বাড়ির মালিক ছিলেন অম্বিকা দাস ও দুর্গাচরণ দাসের পিতা। হীরালাল সেনের ছেলে বৈদ্যনাথ সেনের সহপাঠী ছিলেন এরা দুইজন। ১৯১৭ সালে এই বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

film maker Hiralal Sen's house in kolkata, 18 Blacquire Square 

৪) রায়বাগানের বাড়ি – স্কটিশ চার্চ স্কুলের পাশ দিয়ে ঈশ্বর মিল লেন দিয়ে একটু হেঁটে গেলে বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসুর বাড়ির গা দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে সেটিই হল রায়বাগান। রায়বাগান শেষ হয়েছে গিয়ে হেদুয়ার সামনে। আর যে বাড়িটিকে চিহ্নিত করেছি খুব সম্ভবত হরিতকী বাগান লেনের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এই বাড়িতেই উঠে এসেছিলেন মতিলাল সেন এবং এই বাড়িতেই ছিল ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ এর গুদাম, আর বাড়ির ঠিকানা ২৪এ রায়বাগান স্ট্রীট। এই বাড়ি থেকে হেদুয়ার মোড় খুব বেশি হলে ২০ থেকে ৩০ মিটার হবে। ‘নির্বাক যুগের ছায়ালোকের কথা’ বইতে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী আগুন লাগার দিনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী যেদিন ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ এর গুদামে আগুন লাগে, সেই আগুনের শিখা দেখা গিয়েছিল হেদুয়ার মোড় থেকে। এই কথাটির সূত্র ধরে যদি দেখা যায় তাহলে এই বাড়িটি হেদুয়া থেকে সবথেকে কাছে এবং এই বাড়ির সামনের যেকটি বাড়ি বর্তমান, সেগুলো ১০০ বছরের পুরনো নয়। সুতরাং, সেই সময় এই বাড়ির সামনের ৩০-৪০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বাড়ি থাকার সম্ভবনা খুবই কম। অর্থাৎ, হেদুয়ার মোড় থেকে এই বাড়ির আগুন দেখা যাওয়াটাও খুব অস্বাভাবিক নয়। সেই অনুযায়ী এবং আরও কয়েকটা তথ্য অনুযায়ী এই বাড়িতেই ছিল গুদাম।

film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Raibagan film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Raibagan film maker Hiralal Sen's house in kolkata, Raibagan

মহাদেও গোপাল পটবর্ধন ও শাম্বরিক খরোলিকা – মহাদেও গোপাল পটবর্ধন ও তাঁর আবিষ্কৃত ‘শাম্বরিক খরোলিকা’ সম্পর্কে দু এক কথা। সিনেমা আবিষ্কারের কিছু বছর আগে মহাদেও গোপাল পটবর্ধন নামের এক মারাঠি, ম্যাজিক ল্যান্টার্নের সাহায্যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছেন। সেই গুলি কতটা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ‘শাম্বরিক খরোলিকা’ বা অন্য অর্থে উন্নততর ম্যাজিক ল্যান্টার্নের সাহায্যে স্থির স্লাইড দেখান কে কি সিনেমা বলা যেতে পারে? যাইহোক, প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলতো তাঁর প্রদর্শন। আর এই প্রদর্শনকে আরও জীবন্ত করার জন্য বিশেষত গল্পের চরিত্র গুলিকে জীবন দেওয়ার জন্য পেছন থেকে সংলাপ বলা হত। মহাদেও গোপাল পটবর্ধন হলেন মারাঠি মানুষ এবং শাম্বরিক খরোলিকা এই নাম থেকে বোঝা যায় তিনি মনে প্রাণে কতটা দেশীয় ছিলেন। তাঁর এই নিজের তৈরি কৌশল বা আবিষ্কার যাই বলুন তার নামকরণ করেছিলেন সম্পূর্ণ দেশজ। তাঁর এই আবিষ্কৃত কৌশলের নাম রেখেছিলেন ‘শাম্বরিক খরোলিকা’। ‘শাম্বরিক’ হল হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর এক দানব চরিত্র। সে দানব হলেও মানুষের কোন ক্ষতি করতোনা বরং মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য নানা মজা করতো। ‘খরোলিকা’ এই কথাটি অধিকাংশ জায়গায় মারাঠি আখ্যা করলেও, মারাঠি অবিধানে খরোলিকা খুঁজে পাইনি। মারাঠিতে লন্ঠনকে কুন্দিল বলা হয়। বরং, ‘খরোলিকা’ সংস্কৃত অভিধানে পাই যার আক্ষরিক অর্থ বাংলাতে জাদু লন্ঠন। যাইহোক, দাদাসাহেবের আগেও যে এ দেশের চলচ্চিত্রের একটা ইতিহাস আছে তা ভুলে গেলে চলবে না। মহাদেও গোপাল পটবর্ধনের জীবনেও আগুণের একটা ভূমিকা ছিল। এই আগুনই কোথাও যেন তাঁকে হীরালাল সেনের সাথে মিলিয়ে দেয়। এক অগ্নিকাণ্ডে মহাদেও গোপাল পটবর্ধনের দু পুরুষের শ্রমের এবং ভালবাসায় তৈরি বহু স্লাইডস্ পুড়ে শেষ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, ১৯৬০ সালের বন্যায় নষ্ট হয় আরও বেশ কিছু স্লাইডস্। তা সত্ত্বেও, তাঁর বেশ কিছু স্লাইডস্ আর ম্যাজিক ল্যান্টের্ন আজও অক্ষত রয়েছে। পটবর্ধনের নাতনি ডি. আর. পটবর্ধন ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভে মহাদেও গোপাল পটবর্ধনের ৪০০ স্লাইডস্ ও ম্যাজিক ল্যান্টের্ন দান করেন। এই সমস্ত অমূল্য সম্পদ পুনের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভের প্রদর্শনশালায় রাখা হয়েছে।

সর্বশেষে বলি, অনেক কথা বলা হয়ে উঠল না, তার মূল কারণ আমি এই লেখা বেশি দীর্ঘায়িত করতে চাইনি। কিন্তু কিছু কথা না বলে এ লেখা শেষ করা, আমার মনে হয় ঠিক হবে না। আসলে আমি তো কোন ফিল্ম বিশেষজ্ঞ বা চলচ্চিত্র গবেষক নই, তাই হীরালাল সেনকে আক্ষরিক অর্থে খুঁজতে আমার সাহায্যের দরকার ছিল। তাই অনেক আশা নিয়ে অনেকের দরজায় কড়া নাড়তে হয়েছিল। তাতে বিশেষ কিছু লাভ পাইনি। এর থেকে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। কিন্তু এখানে দু এক জনের কথা না বললেই নয়। বেশ কয়েকদিন আগে, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কলকাতার এক স্বনামধন্য ফিল্ম ইন্সিটিউটের ফিল্ম ডিরেকশানের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টের এক ফিল্ম ওয়ার্কশপে উপস্থিত থাকার। তিনি ফিল্মের ইতিহাস বলতে গিয়ে দাদাসাহেব থেকে বলা শুরু করলেন। আমি গিয়ে অনুরোধ করেছিলাম অন্তত হীরালাল সেন সম্পর্কে দুএক কথা বলার জন্য। তার শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিলো তিনিও হীরালালকে নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না এবং তার সে ইচ্ছাও নেই। সেখানেই থেমে থাকিনি আমি। এরপরে সাহায্য চেয়েছি সরাসরি হীরালাল সেনকে নিয়ে এই লেখার জন্য। সাহায্য তো দুরস্ত তিনি সাহায্যের আশ্বাস টুকুও দেননি। বারবার মনে হয়েছে কেন বাঙালি হয়েও বাঙালির কাছেও হীরালাল ব্রাত্য? আরেকজন মানুষের কথা বলতে ইচ্ছা করছে তিনি নন্দনের ফিল্ম আর্কাইভে চাকরি করেন। তিনি আমাকে তার মত করে সাহায্য করেছেন। আমি তার কাছে সত্যি ঋণী। বাংলাদেশের আরেক বন্ধুর কথা বলা দরকার। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বগজুরি গ্রামে হীরালালের বাস্তুভিটার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। তিনি বৃদ্ধ মানুষ হয়েও আমার কথা ফেলতে পারেননি । দুঃখের বিষয় সেখানে গিয়েও তিনি  হীরালালের কোন স্মৃতিই খুঁজে পাননি। সে তো অদৃষ্ট কিন্তু তার এই উপকার আমি কোনদিন ও ভুলতে পারবোনা। আরেকজনের কথা বলি, তিনি হলেন আরিয়া যোশী। যখন আমি ‘শাম্বরিক খরোলিকা’ এর আক্ষরিক অর্থ তন্নতন্ন করে খুঁজছি তখন সুদূর মুম্বাই থেকে ইনিই আমাকে সঠিক পথ দেখান। ধন্যবাদ মারাঠি উইকিপেডিয়ান আরিয়া যোশীকে।

গ্রন্থ-পঞ্জী
১। বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাস – কে. মুখোপাধ্যায়
২। জ্ঞাননৌকা ও অন্যান্য প্রবন্ধ – জি. রায়
৩। ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন (দ্বিতীয় সংস্করণ)
৪। Cinema in Calcutta 1897 – 1939 (A research paper by R. Chatterjee)
৫। বিবিধ সংবাদ পত্র
৬। কলকাতার ইতিহাস দিনলিপি – এন. বি. হাজরা
৭। বাঙালি চরিতাবিধান – অঞ্জলি বসু
৮। বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্রের ইতিহাস – রবিন বন্দ্যোপাধ্যায়
৮। Bombay before Bollywood – R. Thomas
৯। অমৃতলাল বসুর জীবন ও সাহিত্য – অরুণ কুমার মিত্র
১০। নির্বাক যুগের ছায়ালোকের কথা’ –  আতর্থী প্রেমাঙ্কুর
১১। সোনার দাগ – গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ

স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।

যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।

বং ব্লগার

"বং ব্লগার" একজন আস্ত পাগল, অশিক্ষিত, জ্ঞানগম্য হীন ট্রাভেলার। পথের সম্বল সামান্য পুঁজি যা মাঝে মাঝে জোটেও না, আর মনে অজানাকে জানার ও দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়ত, সবটাই ভোরের স্বপ্ন, তাতে কি যায় আসে? হয়তো সবটাই কাল্পনিক, তাতেও কি কিছু যায় আসে? সবটা মিলিয়েই আমি চিৎকার করে বলতে চাই, আমি "বং ব্লগার"।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 3 =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.