ঝরা সময় # ফিলিং ১

সময়টা ওর ঠিক মনে পরেনা। সম্ভবত, যে সময় সব সুন্দরী বা ফর্সা মেয়েদের নাম মনেহয় পিঙ্কিই হত। বা বলা যেতে পারে যে সময় “হাম বনে তুম বনে এক দুজে কে লিয়ে” বা “আব হ্যাঁয় জুদাই কা মৌসম” সেই সময়ের কচি কচি মন গুলিকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে, হয়তো সেই সময়ের কথা বলতে চাইছে। আমি বুঝে নিতে চাইছিলাম সময়ের উষ্ণতা টুকু। বলে রাখা ভাল যে, আমি কিন্তু কোন গল্প লিখতে বসিনি বা আমি যা জিনিস তার দ্বারা আর যাই হোক লেখালেখি হবেনা, তা আমার বেশ জানা। একজনের জীবনের এক টুকরো রেশ, হারিয়ে যাওয়া সময় আমার কাছে আসতেই, ভাগ করে নেবার লোভ সামলাতে না পারার ফল এটা। সবটাই সত্যি, আবার সবটাই বিছিন্ন, আবার কখন গল্পও বটে। সে তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে মানে অর্জুনদা  আর পিঙ্কি তার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে লরেটো তে পড়ে। ভারি মিষ্টি দেখতে পিঙ্কিকে, অনেকের মত তার ও মনে হত অনেকটা ডিম্পল কাপাডিয়ার মত লাগে ও কে। কোন এক পারিবারিক সূত্রে, পিঙ্কির তাদের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল। তাও খুবই কম। পিঙ্কি জানতই না তার অগোচরে কেউ তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এতটাই সেই আকর্ষণের তীব্রতা, সে ওই বয়েসেই দাঁড়ি কামাতে চায়, হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পড়তে চায়, চুলের ভাঁজ নিজে থেকে যায় ঘুরে তাকে দেখলে। পুজোর অষ্টমীর জামাটা যেন তার জন্যই তোলা থাকে। আরও কত নানান স্মৃতি অর্জুনদার। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সাধারণ ছিলনা কারণ বাংলা মিডিয়ামের ছেলের ইংলিশ মিডিয়াম প্রেম। বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলের ইংলিশ মিডিয়াম গার্লফ্রেন্ড মানে বিশাল ব্যাপার, বিশেষ করে বন্ধু মহলে। শুধু কি তাই? জিন্সের প্যান্ট ও পরে সেই সুন্দরী। যে ঝরা সময়ের কথা বলছি, সেই সময়টা এই রমকমই ছিল। পিঙ্কির স্কুল বাস না এলে,  ওর ৩৪বি তে করে স্কুল যাওয়া। আর সেই সময় গোলবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু মুখে বসে থাকা পিঙ্কির মুখের এক ঝলক। তাই নাকি সারাদিনের খোরাকী।

 

কয়েক সেকেন্ডর স্মৃতি এত উজ্জ্বল হতে পারে, সত্যি আমার জানা ছিলনা। আমার কিন্তু বেশ লাগছিল। আমার থেকে বড় একজনের থমকে যাওয়া সময়ের কথা শুনতে। বারবার প্রশ্ন করছিলাম অর্জুনদা এরপর কি হল গো? ওরপর কি হল গো? হাহাহাহা, প্রশ্নবাণ বুঝলেন, প্রশ্নবাণ। মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিল সে, তখন আমারও নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাবার জন্য। বয়সের নিয়মে বেশ মেদের প্রভাব থাকলেও  মাঝে মাঝে কথার ফাঁকে ভাজ পরে যাওয়া চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল লাগছিল অর্জুনদার। ওই যে চিকচিক করে ওঠেনা চোখ, ঠিক অমনি আমি দেখলাম অর্জুনদার চোখে। এবার একটু এগোই, তা না হলে এ লেখা শেষ হবেনা, আমি তো আর গপ্পো লিখতে বসিনি। বলে রাখা ভাল, একটি বিশেষ কারণ ছিল আমাকে তার এই কথাগুলি বলার। যাইহোক, এবার একটু এগোনো যাক।

 

সেই বহুকাঙ্ক্ষিত সময় এলো অর্জুনদার জীবনে। একদিন তার এই অনুভূতির কথা, বার্তা হয়ে সুন্দরীর মরমে পশিল আরকি। এতদিন তাই তো চেয়েছিল। কিন্তু সে তার কথা জেনে গেছে শুনে অর্জুনদার টেনশান গেল বেড়ে। আসলে কি হবে ? কি হবে? ভেবে। অবশ্য রিজেকশানেরও ভয় ছিল মনে। দিন চলে যায়, সেদিক থেকে কোন খবরই আসেনা। হঠাৎ একদিন, একটি ক্যাডবেরি, আর লাইন টানা খাতার পাতায় লেখা বেশ কয়েক লাইনের একটি চিঠি জুটল তার ভাগ্যে। কে আর দেখে সেদিন তাকে। মাকে কোন রকম বুঝিয়ে বেড়িয়ে পরার তাল। আনন্দে সে ফুলপ্যান্ট পড়ে বেড়িয়ে পরল নিরুদ্দেশের পথে। কি লিখেছে সেটাতো পড়তে হবে তাকে। কোথায় বসে পড়বে, বাড়ির ছাঁদে? ধরা পড়ে যেতে পারে। শুধু কি তাই, এই অমূল্য চিঠি সে রাখবে কোথায়? নানান প্রশ্ন, আশঙ্কা নিয়ে পথ হাঁটা শুরু। সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই সে দেখে নিয়েছিল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাতে লেখা অর্ধেক চিঠি আর বাদবাকিটা ইংলিশে। এমনিতেই সে দু তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে নামতে পারদর্শী। কিন্তু সেদিন এক লাফে দোতলা থেকে একতলা নেমে গেল। হাটতে হাটতে অনেক দুর আসার পর চিঠি খুলে পড়া। এখন আর মনে পড়েনা তার, কি লেখা ছিল সেই চিঠিতে। কিন্তু হাল্কাহাল্কা মনে পড়ে তার, তার কোন হিরো পছন্দ সেটা লেখা ছিল, দাদার কাকে পছন্দ জানতে চেয়েছিল সে। কত গুল নাম তার সঙ্গী হল সেদিন থেকে সুন্দরীর পছন্দের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে, যেমন, জর্জ মাইকেল, পিট্‌ সিগার, ডিলান। এরপর, স্কুল বাস না এলে ৩৪বি থেকে এক বা দুবার পিঙ্কি তাকিয়ে দেখেছে তার দিকে। এর থেকে গপ্পো আর বেশিদূর গড়ায়নি। একদিন অর্জুনদা জানতে পারল ফ্রাঙ্ক অ্যানথনিতে পরে, বেশ ফর্সা মার্কা এক ছেলের সাথে পিঙ্কির প্রেম। তখন আমির খান মার্কেটে এসে গেছে। তাই কেলে অর্জুনদার বাজার বড্ড বাজে। এ শুনে বিস্তর আঘাত পেয়েছিল অর্জুনদা। শুরু হল, সব রকমের স্যাড সং শোনা এবং দুঃখে আরও নানান কিছু করেছিল সেইসময়। সে সব এখানে বলা যাবেনা। এ ভাবেই চলেছিল বেশ কিছু বছর। আসতে আসতে তারা দুজনেই বেড়ে উঠেছে সময়ের হাত ধরে। তারপর, একসময় সেই ছেলের সাথেই বিয়ে হয় পিঙ্কির। আর এদিকে অর্জুনদার দেখেশুনে বিয়ে হয়, মানে আমাদের সঙ্গীতা বৌদির সঙ্গে।

 

দীর্ঘ পঁচিশ বছর কেটে গেছে। পিঙ্কি নামটা কিন্তু থেকে গেছে অর্জুনদার সঙ্গে। কয়েক দিন আগে অর্জুনদার এক আত্মীয়ের থেকে নেমত্তন্ন পেয়ে  গিয়েছিল উত্তর কলকাতার কোন এক রেস্তরাঁতে। বহুবছর পর অনেকে অর্জুনদাকে দেখে খুব খুশি। তারা নানান স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে ব্যাস্ত। হঠাৎ করে অর্জুনদার চোখ পড়লো এক মহিলার দিকে। এক ঝলক, চিনতে অসুবিধা হলনা অর্জুনদার। সেই পঁচিশ বছর আগে ফেলে আসা স্মৃতি। এখনো সেই দীপ্তি, উজ্জ্বলতাকে বয়স ছুঁয়েও যেতে পারেনি। মনে পড়লো, বছর দুয়েক আগে অর্জুনদা খবর পেয়েছিল পিঙ্কির বর হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যায়, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। খানিক ক্ষণের নিস্তব্ধতা,  অবাক হওয়া পেরিয়ে অর্জুনদার চৈতন্য ফিরতেই, দেখলো সামান্য হলেও রাগ ছিল যার ওপর, মুহূর্তের মধ্যে সে রাগ দুঃখে পরিবর্তিত। আসলে, আজ অর্জুনদা নিজেও তো ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ের বাবা। তাই বুঝতে পারলো ক্লাস টেনে পড়া ছেলেকে নিয়ে সে কতটা সমস্যায় পরেছে। যাইহোক, ফিরে আসা যাক রেস্তোরাঁর সেই মুহূর্তে। অনেক ছবি এখন জলছবি, তাও নাকি সুখের। এখন ওর ছেলে ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, ওরই পাশে দাঁড়িয়ে। মুহূর্তের মধ্যে ছেলেকে নিয়ে সে বেড়িয়ে গেলো রেস্তোরাঁ থেকে, খানিক দুরে দাঁড়িয়ে অর্জুনদা। হঠাৎ কি হল অর্জুনদার সে নিজেও জানেনা। মানুষ সবসময়ই সময়ের বিপক্ষে যেতে চায়। সেদিনের বড় হতে চাওয়ার মজা বুঝে নেওয়া মন আবার ছোট হতে চায় বোধহয়। মেয়েকে বলল দাঁড়া আমি আসছি। আসলে ভাল করে যে দেখা হয়নি তাকে। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সেই আগের মতো এক লাফে রেস্তোরাঁর গেটের বাইরে বেড়িয়ে এলো। এক ঝলকে সে দেখতে পেলো ছেলেকে পাশে বসিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে মিলিয়ে গেলো উত্তর কলকাতার গলিতে। হয়তো আবার দেখা হবে বা আর কোনদিনও হবেনা। কিন্তু স্মৃতির এক বিশেষ জ্বালা আছে, সেটা হয়তো থেকে যাবে। সেই জ্বালার ফল হল, তার থেকে ছোট এক ছেলেকে ডেকে তার এই বলে ফেলা।

এক আশ্চর্য নীরবতা নেমে এলো আমার আর অর্জুনদার সামনে। আমার মনে হল এটাও তো ভ্রমণ কাহিনি। যেখানে আমি না আমার আত্মা ভ্রমণ করছে। আজ আসি, মিলিয়ে গেলো অর্জুনদাও আমার কাছ থেকে।

 

স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।

যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।

বং ব্লগার

"বং ব্লগার" একজন আস্ত পাগল, অশিক্ষিত, জ্ঞানগম্য হীন ট্রাভেলার। পথের সম্বল সামান্য পুঁজি যা মাঝে মাঝে জোটেও না, আর মনে অজানাকে জানার ও দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়ত, সবটাই ভোরের স্বপ্ন, তাতে কি যায় আসে? হয়তো সবটাই কাল্পনিক, তাতেও কি কিছু যায় আসে? সবটা মিলিয়েই আমি চিৎকার করে বলতে চাই, আমি "বং ব্লগার"।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × one =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.