ঝরা সময় # ফিলিং ৩

“প্রেম কি মুড়ি মুড়কি নাকি? বারবার তোমার জীবনে প্রেম আসে?” আমার সোজা প্রশ্ন অর্জুনদার কাছে। আমার কথা শুনেই হাসতে শুরু করল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তোমার ঐ বন্ধুর বোনের কেসটা কি হল বললে না তো সেদিন। একটু অনুরোধ করতেই কেমন যেন নরম হয়ে গেল অর্জুনদা। বললো চল আগে একটা বিড়ি ধরাই তারপর ওটা নয় আরেকটা বলবো। আমি তো অবাক, ও তো বিড়ি খায়না, খায়তো সিগারেট। জিজ্ঞাসা করলাম, সেকি তুমি আজ বিড়ি খাবে কি ব্যাপার? ওর সোজা উত্তর ‘যে সময়ের কথা বলবো, ঐ সময় বেকার ছিলাম, তাই বিড়িই খেতাম। তাই ঐ মুডটা ধরার জন্য এই বিড়ি’। এরপর আগামী দুই ঘণ্টা অর্জুনদার থেকে শুনেছিলাম আরেক গল্প তার জীবনের। সেদিন আর ঐ বন্ধুর বোনের গপ্পোটা আমার শোনা হলো না। তার বদলে অন্য একটা গল্প শুরুকরলো সে …

যেহেতু, অন্যের ব্যাক্তিগত কথা পাবলিক করছি, তাই আগাম ক্ষমা চেয়ে নিলাম অর্জুনদার থেকে। আর আপনাদের বলি একটু কষ্ট করে পড়ে নেবেন, কারণ লেখালেখিটা আমার ঠিক আসেনা।

“তখন, আমি কলেজে। যতদূর, মনে পড়ে সেকেন্ড ইয়ার হবে। উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ পাড়ার মুখে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছি, দেড়টা বা দুটো হবে, রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকা। মোদ্দা কথা দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি তখনও আমার। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় বাঙালি লাঞ্চ করতো না, দুপুরের খাওয়া খেত। এক সুন্দরী এসে দাঁড়াল বাস স্ট্যান্ডে। কাঁধে তার ব্যাগ আর হাতে মোটামোটা দু চারটে বই। মুখটা ভারি স্নিগ্ধ ও শান্ত। আগেও দেখেছি একে এখান থেকে মাঝেমাঝে বাস এর জন্য দাঁড়াতে। একদম ভাবার কিচ্ছু নেই যে ওখানে আড্ডা দিতাম আর মেয়েদের উত্যক্ত করতাম। সেই সময় বদলে দেওয়ার স্বপ্ন চোখে, কোন এক ‘ম্যানিফেস্টো’ ও পড়ে ফেলেছি। আশেপাশে অনেকেই চেনে, তাই ওখানে দাঁড়িয়ে বিড়ি আর সমাজ বদলের স্বপ্ন ছাড়া আর সব কিছুই ছিল নিষিদ্ধ ইস্তেহারের মতন। এখনও মনে আছে, পিঙ্কি চলে গেল আগেই, আমি, দীপ আর নির্মলদা দাঁড়িয়ে ছিলাম। দীপ আর নির্মলদাও বেড়িয়ে গেল, বলে গেল চারটে নাগাদ দেখা হবে আবার। সেই সময় রাজবল্লভ পাড়ার মোড়ের ডানদিকের ফুটপাথটার একটা অংশে রেলিং দেওয়া ছিল। আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে গিয়ে বসলাম রেলিং এর ওপর। যতই রাজনীতি করি, সবশেষে আমি মানুষতো। তাই মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছিল মেয়েটার দিকে। মেয়েটির কোন ভ্রুক্ষেপও নেই কোনদিকে, সে তার আপন খেয়ালে বইয়ের পাতা উল্টে কি যেন দেখছে। একটু হলেও খারাপ লাগছিল মেয়েটা একবারের জন্যও আমার দিকে তাকিয়েও দেখছেনা বলে। ঠিক সেই মুহূর্তে, নবীন চন্দ্রের মিষ্টির দোকানের সামনে থেকে একটা বাস ঝড়ের বেগে এসে মোড় নিলো, কিন্তু ব্রেক মারতে মারতে একটু দেরি করে ফেলেছিল বাসটা। ধুপ করে একটা শব্দ হল। আর তার সাথে ‘আ..আ…’ এক আর্তনাদ। ছুটে গেলাম সামনে, তীব্র গতিতে বেড়িয়ে গেলো বাসটা চোখের সামনে দিয়ে। খানিক দুরে ছিটকে গিয়ে পড়েছে মেয়েটা আর এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ে আছে ব্যাগ আর বইগুলো। সামনে যেতেই দেখলাম কাঁচা রক্ত বেড়িয়ে আসছে মেয়েটির কোমরের নিচ থেকে। সামনে এতো কাঁচা রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেছিলাম। বেশ হাল্লাচেলা শুরু করলাম, অনেকে এগিয়ে এলো কিন্তু মেয়েটাকে কেউ হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইলো না। শুধু কি তাই? হাত দিতেও চাইলো না। বর্তমানে যে আইন হয়েছে, তা তখন ছিলনা। পুলিশের ভয়ে কেউ এগিয়ে এলোনা। কে পরতে চায় ঝামেলায়? আমি এগিয়ে গেছিলাম কারণ আমি তখন সর্বস্ব হারিয়ে যারা পথে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার অঙ্গীকার নিয়েছি যে । সর্বস্ব হারিয়ে যারা পথে এসে দাড়ায় তাদের যেন এক কথায় কি যেন একটা বলা হতো সেই সময়। অনেক আগের কথাতো তাই এখন আর মনেও পড়েনা। তখন পরিস্তিতি এমন, কাউকে যে ডাকব তারও উপায় নেই আমার। আশেপাশে কোন এসটিডি বুথও নেই, আর মোবাইল ফোন আসতে তখনও আরও বেশ কিছু বছর বাকি। যাই করি আমাকে হেঁটে যেতে হবে খানিকটা আর হাতে সময়ও কম।

Jhora Somoy # Feeling 3B

আস্তেআস্তে দেখতে পাচ্ছিলাম মেয়েটার শান্ত মুখখানা আরও শান্ত হয়ে যাচ্ছে। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালাম। পকেটে তখন খুচরো আর নোট মিলিয়ে বড়জোর খান দশেক টাকা। ওর বই আর ব্যাগ ট্যাক্সিতে রেখে, দুহাতে তুলে নিলাম ওকে রাস্তা থেকে। আমার হাতে তখন ওর প্রায় নিথর শরীর, বেশ ভারী লাগছিল। হঠাৎ কানে এলো একটা কথা ‘অর্জুন তাড়াতাড়ি করো’। মেয়েটির যোনি থেকে বেড়িয়ে আসা রক্তে তখন ভিজে যাচ্ছে আমার দু-হাত। ঐ মুহূর্তে একটা নতুন অনুভূতি হয়েছিল, কি সেই অনুভূতি তা বলে বোঝান বড্ড কঠিন। আমাকে চিনল কি ভাবে? ও কি আমাকে চেনে? আর তার সাথে ভয়, কাঁচা রক্ত, মেয়েটার কাছে স্বপ্নের পুরুষ হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে নির্মম মুহূর্তেও যৌনতা মেশানো শরীরের স্বাদ, নারী শরীরের নিজস্ব এক গন্ধ আছে, সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক বিচিত্র অনুভূতি। ছুটলাম নিয়ে আর জি কর হসপিটালের দিকে। যারা এই রাস্তায় এসেছেন তারা জানে, খুব বেশি রাস্তা নয়। এই প্রথম কোন মেয়ের সাথে একা হলাম ট্যাক্সির ঐ সীমিত পরিসরে। হসপিটালের যতই কাছে এগোচ্ছে গাড়ি, তত এক অজানা ভয় ঘিরে ধরতে লাগলো আমাকে। অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল হসপিটালে ভরতি করার জন্য। শ্যামপুকুর থানার কেস, থানার ছোটবাবু আমাকে দেখেই চিনতে পারলো। রাজনীতি করার এটাই হয়তো সুবিধা। এরপরে আমাকে জেরা করা বন্ধ হল। হসপিটালে ভর্তি করে ফিরে এলাম বাড়ি। মেয়েটার বাবা মাকে পুলিশই খবর দিয়েছিল। ওরা আমার সাথে দেখা করতেও চেয়েছিল কিন্তু দেখা হয়নি। আমি দেখতেও গেছিলাম মেয়েটাকে নিয়ম করে আর খবরও নিতাম। এই ঘটনার দুদিন পরে, বিকেল বেলায় পার্টি অফিস থেকে বেড়িয়ে সোজা গেলাম আর-জি-করে। কে জানে কেমন আছে মেয়েটা ….

গিয়ে শুনলাম সেদিনই দুপুর একটা নাগাদ স্নিগ্ধা মারা গেছে। পোস্টমরটেমের পরে বডি নিয়ে চলে গেছে পরিবার। এই প্রথম কোন শরীরকে ‘বডি” হতে দেখলাম। হ্যাঁ, ওর নাম ছিল স্নিগ্ধা মুখার্জি, সেকেন্ড ইয়ার ফিজিক্‌স অনার্স, জয়পুরিয়া কলেজ।

শুধু জানা হলনা এর অর্থ ‘অর্জুন তাড়াতাড়ি করো’।

 

 

চিত্রঅঙ্কনমিতাদ্রু বিশ্বাস
স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।

যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।

 

বং ব্লগার

"বং ব্লগার" একজন আস্ত পাগল, অশিক্ষিত, জ্ঞানগম্য হীন ট্রাভেলার। পথের সম্বল সামান্য পুঁজি যা মাঝে মাঝে জোটেও না, আর মনে অজানাকে জানার ও দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়ত, সবটাই ভোরের স্বপ্ন, তাতে কি যায় আসে? হয়তো সবটাই কাল্পনিক, তাতেও কি কিছু যায় আসে? সবটা মিলিয়েই আমি চিৎকার করে বলতে চাই, আমি "বং ব্লগার"।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − 14 =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.