সালটা ১৯৯২, মার্চ ১২
লোকাল ট্রেনের জানলায় বসে, রাত গভীর হয়ে নেমে এসেছে।
জানতাম না ক্লান্ত পাখির মতো নেমে আসা রাতও আমার ভালো লাগে।
আমি সত্যিই জানতাম না, আমার আকাশ ভালো লাগে।
মেঘলাই হোক বা নীল।
আমি সত্যিই জানতাম না, আমার গাছ ভালো লাগে।
ঝরে যাওয়া পাতায়, জড়িয়ে ধরা গাছের ডালে।
আমি সত্যিই জানতাম না, আমার রাস্তা ভালো লাগে।
যে রাস্তার শেষে, বৃষ্টি নেমে আসে।
আমি সত্যিই জানতাম না।
আমাকে কিন্তু এই খেলাটায় বেশ পেয়ে বসেছে, অর্জুনদা আর তার জীবনের নারী। অনেকেই ভাবতে পারে অর্জুনদা তো আর রবীন্দ্রনাথ নয়, যে ওর জীবনের নারীর ভূমিকা জানতে হবে। তা একেবারে সত্যি। প্রথম দিকে আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মনে হয়েছে, এক সাধারণ মানুষের জীবনে, তার নিজের মতন করে অনেক অসাধারণ যাপন থাকে। তা জানতে ও জানাতে সমস্যা কোথায়? আসলে আমরা নিজেরা এতটাই সাধারণ এবং আমাদের জীবনটাও তার থেকেও বেশি সাধারণ, তাই আমাদের জীবনের থেকে বড় জীবন না হলে বোধহয় আমাদের মনে ধরেনা। বিশ্বাস করুন আমার কিন্তু অর্জুনদার ফেলে আসা মুহূর্ত গুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। একটা সময় ছিল যখন অর্জুনদা নিজের মনের বোঝা কমাতে আমাকে খুঁজে বেড়াত। আর আজ, পরিবর্তিত ছবিতে আমি অর্জুনদাকে খুঁজি ওর জীবনের গল্প শুনব বলে।
আজ অর্জুনদা ফেসবুকে, কাকে যেন একটা খুঁজে পেয়েছে। তার কথাই শুনে এলাম, আর আজ তাকে নিয়েই বলব।
ক্লাস টুয়েলভে পড়ি, আমার পরিবার তখন কলকাতার পাঠ চুকিয়ে, কলকাতার পাশে এক মফঃস্বলে। আমার বন্ধু বাদশা, খুব ভাল বন্ধু। এক সাথে এস এন দে এর কাছে ম্যাথসের ফার্স্ট পেপার পড়ি, তাই অঙ্কতুত, কোচিংতুত বন্ধুও বটে। সবাই জানে এ পি সি কলেজের এক মেয়ের সাথে ওর প্রেম চলছে, তার নাম নিতা। তাকে নাকি দারুণ দেখতে। বাদশাও কম যায়না তখন, আসেপাশে সেও শাহরুখ খান বলে বেশ পরিচিত। ঐ চারা শাহরুখ আরকি। আমি তখন রাজনীতি করি কিন্তু তখনও আমার রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু এই সময়টায় আমার মধ্যে থাকা অন্য অর্জুনগুলি শেপ্ পাচ্ছিল। একটু খুলে বলার দরকার, যে অর্জুন ব্রুস স্রিংস্টিন, পিংক ফ্লয়েড শুনছে সেই অর্জুন আবার ‘মরণের পারে’ পড়ছে, বড়বড়িয়া শ্মশানে ঘুরছে সেই অর্জুনের সাথে কনফ্লীক্ট করছে। আসলে, অর্জুনের মধ্যে বসবাস করা প্রত্যেকটা অর্জুনের সাথে পারস্পরিক কনফ্লীক্ট চলছে। এই রকম এক দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিতে নিতার সাথে পরিচয় হয় আমার। নিতার সাথে আলাপের দিনটা আজও স্পষ্ট স্মৃতিতে, অবয়ব স্মৃতি থেকে মুছে গেছে বহু কাল আগেই। তাও চোখ বন্ধ হলে ছিপছিপে লম্বা, ফর্সা, শান্ত ভাবে ভাসিয়ে দেয়া কথা বলা কোন এক ছবি আজও দেখতে পাই। যাইহোক, আসা যাক সেই সকালের কথায়।
সেইদিন সকাল বেলা, জাতীয় সড়কের ওপর এক চায়ের দোকানে বসে আছি। বেশ ফাঁকা চায়ের দোকান, আমি ছাড়া এক দুজন বসে চা খাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম আস্তেআস্তে চায়ের দোকানে ভিড় বাড়ছে। ভিড় এতোটাই বাড়ল যে চায়ের দোকান উপচে পড়ল, প্রায় ৫০-৫৫ জন হবে। চার পাঁচজনের হাতে ওয়ান সাটার, আমার মাথায় ঠেকানো। বাদ বাকিদের অনেকের হাতে ভোজালি, চাকু আরও কত কি। বুঝলাম, আজ ওরা আমাকে মারতে এসেছে। এতটাই বাজে অবস্থা হল, যে এক মুহূর্তে মনে হল আজই আমার শেষ দিন। সেই সময়, পাস দিয়ে এক পুলিশের গাড়ি যাচ্ছিল, গাড়িতে বসা আমার পরিচিত পুলিশ অফিসার। অফিসার নেমে এসে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলল। আমি বললাম ‘কাকু কিছু নয় আপনি যান আমি বুঝে নেব’। সেইসময়, বুঝে নেবার মতো হয়তো সাহস ছিল, যা আজ নেই। ঐ গণ্ডগোলের মধ্যেও চোখে পরেছিল উল্টো দিক দিয়ে বাদশা আর নিতা এদিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে, ওরা কিন্তু আমাকে দেখেনি। ঐ প্রথম এক ঝলক। সেদিন বেঁচে ফিরেছিলাম। চায়ের দোকান থেকে বেড়িয়ে গেছিলাম আমার প্রিয় বন্ধু গৌড়ের কাছে। গৌড়ের বাড়ি বসে আছি, ডাক পড়ল বাদশার, বেড়িয়ে দেখি ওর সাথে নিতা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা দুজনেই আমার এই ঘটনার কথা জেনে গেছিল ততক্ষণে। আমাকে দুজনেই বেশ খানিকটা মনের জোর দেবার চেষ্টা করল। যতদূর মনেহয় তখন মা আর বাড়িতে নেই, বেশ অনেক দুরে থাকে। গল্প করা শুরু হল ওঁদের সাথে। এক ফাঁকে নিতা একটা কথা বলেছিল ‘আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন কারণ আপনি অনেকের কাছে প্রয়োজনীয়’। কানে যে কথাটা আটকায়নি আজ আর জোর দিয়ে বলা যায়না। কারন, প্রথম জানলাম আমিও নাকি প্রয়োজনীয়।
এরপর নিতার সঙ্গে আমার প্রায় দেখা হওয়া শুরু হয়। যে সময়ের কথা, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে মাগিবাজ, বুর্জোয়া কবিও বটে। এ হেন রবিকে নিয়ে আমি নিতার সাথে মাঝেমাঝেই তর্ক জুড়ে দিতাম। ওর থেকে প্রথম জেনেছিলাম, কি ভাবে বাংলা গানের পরিকাঠাম বদল করেছেন রবিঠাকুর আর কেন তিনি নীলকান্ত মনি। অনেক কিছু শেখা শুরু হল বিশেষত রবীন্দ্রনাথই হতো মূল বিষয়। আর এক বিষয় মিল হতনা আমার সাথে, তা হল বিবেকানন্দ। আমি ছিলাম বিবেকানন্দের অন্ধ ভক্ত, নিতা ঘোর বিরোধী। আমরা তিন জন বসে থাকলে, ও আমার সাথে কথা বলত বেশি। তখন সবাইতো ছোট আমরা অনেক কিছুই ছিল আমাদের বোঝার বাইরে। তাই হয়তো বাদশা আস্তেআস্তে রেগে যেতে থাকল আমার ওপর। আমি নাকি ওর গার্ল ফ্রেন্ডকে ভাঙ্গিয়ে নিচ্ছি। শুরু হল ঠাণ্ডা লড়াই। এর বাইরে আমার আর কোন রকম অনুভূতি ছিলনা নিতার প্রতি। আসলে নিতা এতটাই সুন্দরী ছিল, বাদশা বিশ্বাসী করতে পারল না যে প্রেম শুধু রূপ দেখে আসেনা। বাদশা ভাবত নিতাকে এতটাই ভাল দেখতে যে ওর প্রেমে সবাই পরবে আর সেই যুক্তিতে আমিও পরবো। আমি কথা বলা বন্ধ করে দিলাম ওদের দুজনের সাথে। বোঝাতে পারলামনা নিতার প্রতি আমার কোন প্রেম নেই, ভাললাগে শুধু কথা বলতে। নিতার হাত ধরে যৌবনের ‘আমার রবীন্দ্রনাথের’ পরিবর্তন হল। এই দ্বিতীয় বারের মতো আমার রবীন্দ্রনাথ পরিবর্তনের মুখোমুখি।
উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে আমি ফিরে এলাম শহরে। ততদিনে নিতার সাথে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বছর ঘুরে গেছে। আমার বাড়ির পাশে অর্জুন রায় নামে আরেক দাদা থাকত। একই নাম তাই মাঝে মাঝে আমার চিঠি এদিক ওদিক হয়ে যেতো আরকি। একদিন সেই দাদা আমাকে ডেকে পাঠাল। তাদের ঘরে ঢুকতেই, প্রথম প্রশ্ন ‘নিতা চক্রবর্তী কে?’। আমার মাথা থেকে ততদিনে বেড়িয়ে গেছে নিতার কথা। যাইহোক, জানতে পারলাম সেই নিতা আমাকে দুটি চিঠি দিয়েছে আর সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুটো ক্যাসেট। নিয়ে এলাম সব। চিঠিতে কি লেখা ছিল আজ আর মনে পরেনা। তবে কয়েকটা কথা লেখা ছিল। যেমন, ও প্রেসিডেন্সীতে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ছে। আর দুটো লাইন “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায়ে এসো” এটাতো গুরুদেবের। পরেরটা ওর নিজের “আমি মা হতে চাই”। সাঙ্ঘাতিক, আমিতো ঘাবড়ে গেছিলাম এ পড়ে। ঐ চিঠিতে না ছিল ফোন নাম্বার, না ছিল বাড়ির ঠিকানা। তাই আমার যোগাযোগ করার কোন উপায় ছিলনা।
একদিন হঠাৎ নিতা এসে হাজির হল আমার বাড়িতে। ওর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। নিজের সালওয়ার কামিজ নিজে বানাত, আর তার থেকেও অদ্ভুত নিজে চটিও বানাতে পারতো। দরজা খুলতেই দেখি, পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির ছিপছিপে মেদহীন শরীর, কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া সিল্কের মতো চুল, হাতে অনেক বই, দাঁড়িয়ে নিতা। খানিকক্ষণ বসলো, খুব একটা কথা হলনা সেদিন। আসলে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল আমাদের মধ্যে। দুএক কথার পড় সেদিন সে চলে গেলো। সেদিন শুধু আমি কি বই পড়লাম এত দিনে, আর কি পড়ছি, এই নিয়েই মোটামুটি কথা হয়েছিল। চলে যাবার পর, মনে হয়েছিল আর সে কোনদিন আসবে না। বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। একদিন, আমি পার্টি অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি ও ঘরে বসে আছে। খানিকক্ষণ কথা হলনা, আমি আমার নিজের মতন করে গান গাইছিলাম আর ও খাটের এক কোনায় চুপ করে বসে। এবার সে বলতে শুরু করল, খুব কষ্ট করে সে আমার বাড়িতে এসেছে। আসলে যে কলেজে সে পড়ে সেই কলেজেই ওর জামাইবাবু পড়ায়, তাই ও খুব নজরদারিতে থাকে। বাড়ি পৌঁছাতে এদিক ওদিক হলে সে খুব বকা খাবে। তাও সে এসেছে। আমি বললাম এই ভাবে না এলেও পারতে। বলল এক দরকারে এসেছে সে। কি দরকার? বলল দুটি জিনিস সে চায়, পেলেই সে চলে যাবে। প্রথমে এ কথা শুনে আমি একটু ঘাবড়েই গেছিলাম। ওর চাওয়া গুলো অদ্ভুত হত তো, তাই ঘাবড়ে গেছিলাম। সেদিনের চাওয়া, তার সাথে খানিকটা পথ হাঁটা আর এক মুঠো বর্ষা। সেদিন অনেকটা পথ হেঁটেছিলাম ওর সাথে। বর্ষাকাল, তাই ভিঝলামও কাক ভেজার মতো করে দুজনেই। ঐ যে এক মুঠো বর্ষা। সময় এলো ফুরিয়ে, যাবার সময় ও দুটো কথা বলে গেছিলো ‘পাথরের ভার আছে আলোর আছে দীপ্তি’। আর একটা কথা বলেছিল ‘এক মুঠো বর্ষা চেয়েছিলাম তোমার কাছে, এটাই পুঁজি, বিদায়’। তারপর আর ফিরেও তাকায়নি। সেই যে চলে গেলো, এতো বছর তার আর কোন খবর নেই।
আজ অর্জুনদা পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বাদে নিতাকে আবিষ্কার করেছে ফেইসবুকে, নিতা এখন ফ্রান্সের, মেস্ নামে এক শহরে থাকে।
ছবি – সৃজনী মিত্র
স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।