ঝরা সময় # ফিলিং ৮

আজ দোলের দিনে বড্ড মনে পড়ছে কোন এক ফেলে আসা দোলের দিনের কথা। কেন জানি না, প্রতি বছর বসন্তের হাওয়া আর ঝরা পাতা বড্ড উদাস করে দেয় আমাকে।  আজও বারবার মনেহয় সময় কেন থেমে গেল না সেদিনের ফেলে আসা দোলের সকালে।

টিমটিম করে আলো জ্বলছে আর আমি হেটে চলেছি জাতীয় সড়ক ধরে। পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলেছে দূরপাল্লার বাস  আর লরি। হার্বস্‌ ছিল সঙ্গী, আসলে মেনে নিতে পারছিলাম না জুনের ঐ ভাবে চলে যাওয়া। না বলে যাওয়ার এক অদ্ভুত অজানা অনুভূতি শরীরে তৈরি হয়। তাই অনুভব করছিলাম সেই সময়। বড্ড উদাসীন অগোছালো সেই সময়। তখন মনেহত একমাত্র হার্বস্‌ এর সাহায্যেই ঐ লেভেলে পৌঁছানো যায় যেখানে এর উপশম আছে। অন্ধকার রাস্তা, তাকে আরও অন্ধকার করে তুলেছে জাতীয় সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলো। তখন গাছেরাই আমার পরম আত্মীয়। যেন আমার মনের নির্যাস ওদের জন্য। গভীর হয়ে এসেছে রাত, প্রায় রাত দুটো। হার্বস্‌ও সময় সুযোগ দেখে আমার শরীর থেকে পালিয়ে যাবে যাবে করছে। সম্ভিত ফিরে পেলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম স্টেশানে। প্ল্যাটফর্মের এক বেঞ্চে শুয়ে কাটল রাত। সকালের সূর্যের মৃদু আলো জানান দিল নতুন ভোরের বার্তা। মনেহল বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ি ফিরে দেখি বাড়িতে ধুন্ধুমার কাণ্ড। পুলিসে খবর দেয়া হয়েছে, কারণ আমি নাকি নিরুদ্দেশ হয়েছি। পাড়ার সবাইকে দেখে আমি তো বেশ লজ্জায় পড়লাম। ভাবলাম বেটে কালো রোগা ছেলেটার জন্য এত মানুষ ভাবে, অবাকই হলাম। সবাই চলে যাবার পর খানিকটা উত্তম মধ্যম হল আরকি। যা হয়, বাড়ির ছেলে বাঁদর হলে। এই ভাবে দু একদিন গেল, সঙ্গী হল স্বামী বিবেকানন্দ। ঠিক করলাম সন্ন্যাস নেবো

বাড়ি থেকে বেড়ানো বন্ধ করে দিলাম। একদিন জুনের বন্ধু শর্মিষ্ঠা এলো দেখা করতে। শর্মিষ্ঠাও ছবি আঁকে। কথায় কথায় ওকে বললাম আমার সন্ন্যাস নেবার কথা। আমার সন্ন্যাসের কথা শুনে কেঁদে ফেললো। ও চলে যাবার সময় মাকে বলে গেল যদি মা আমাকে ছাড়ে, তাহলে বন্ধুদের সাথে সবাই মিলে আমাকে নিয়ে ঘুরে আসবে। তাতে আমার নাকি মনের পরিবর্তন হতে পারে। মা এই শুনে রাজি হল কিন্তু আমি সরাসরি না বলে দিলাম। ও সেদিনের মতো চলে গেল। ও যেতেই মা আমাকে বোঝাল যে একটু বন্ধুদের সাথে সময় কাটালে আমারই ভালো লাগবে। পরের দিন সকালে শর্মিষ্ঠা এসে হাজির হল আমাকে নিয়ে যাবে বলে। মা তো রাজি সব বন্ধুবান্ধব মিলে যাবো তাতে যদি আমার মনের পরিবর্তন হয়। বেড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম ওর সাথে। খানিকটা রাস্তা যাবার পর ও বলল ‘কাকিমাকে বলনা শুধু আমি আর তুমি যাচ্ছি’। ‘গাছে কাক আমি তো অবাক’ একি কাণ্ড? কেন? আমি ফিরে যেতে চাইলাম। কেন জানিনা, কি ভাবে ও রাজি করে ফেললো আমাকে। অবশেষে ষ্টেশনে আমাকে ধরে বেঁধে নিয়েই গেল। ট্রেনে প্রায় ঘণ্টা খানেক যেতে হল। বারবার জিজ্ঞাসা করছিলাম ‘কোথায় যাচ্ছি?’। এ বাদে ওর সাথে আমার বিশেষ কথা হলনা। আমার সঙ্গে ছিল আমার ওয়াক্‌-ম্যান। এখনকার প্রজন্ম হয়তো এর কথা জানেই না কিন্তু তখন আমাদের কাছে ওটাই বিশাল বেপার আরকি। যাইহোক, আর তাতে আমি বারবার জন্‌ ডেনভারের “কান্ট্রি রোডস্‌ টেক মি হোম’ এই গানটা শুনছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের জানলার বাইরে ক্রমশ বদলে যাওয়া গ্রাম বাঙলা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আগেও দেখেছি এ রূপ, কিন্তু সেদিন সবটাই ফিকে লাগছিল। জুনের অনুপস্থিতি বারবার অনুভব করছিলাম। যদিও এ পথে আগে কোনোদিনই জুনের সাথে আসা হয়নি। গিয়ে পৌঁছলাম ইচ্ছামতি নদীর কোন এক পারে। অসাধারণ সে জায়গা। পরবর্তীকালে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কিছুতেই ঐ নদীর পার খুঁজে পাইনি। চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। শর্মিষ্ঠা বলল ‘বসে না থেকে মাঠের ওপর শুয়ে আকাশ দেখো, ভালো লাগবে’। আকাশতো রোজই দেখি, কিন্তু নির্জন মাঠের ওপর শুয়ে দুচোখ মেলে আকাশ দেখার মজা প্রথম পেলাম। বলা ভালো এ ভাবেও যে আকাশ দেখতে হয় তা শর্মিষ্ঠার কাছে শিখলাম। চুপচাপ, শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হটাৎ, আধঘুমে অনুভব করলাম স্পর্শের। চোখ খুলে দেখি পাশে শুয়ে শর্মিষ্ঠা। ওর দু হাতে ধরে আছে সদ্য স্কেচ করা আমার ছবি। নিজের পোট্রেট দেখতে বেশ লাগলো। আমার সামনের আকাশে ওর মেলে ধরা আমার সাদাকালো ছবি। বেশ সুন্দর আঁকা। কোথায় কোথায় ভুল আছে জিজ্ঞাসা করাতে বলে দিলাম। ওখানে বসেই ও ঠিক করতে লাগলো। কি কনফিডেন্স ওর লাইন টানায়। বলে ফেললাম সে কথা। হেসে উত্তর দিলো ‘যারা ছবি আঁকে তাদের সাহস নাকি ঐ লাইন টানার ভঙ্গিমায় লুকিয়ে থাকে’। ওর আঁকা ছবি দেখতে চাইলাম। হাসিহাসি মুখে বলল ‘আমি জানতাম যে তুমি আমার ছবি দেখতে চাইবে, তাই কিছু সঙ্গে নিয়ে এসেছি, বাদবাকি আমার বাড়ি যেও সেখানে‌ দেখাবো, এখানে শুধু কিছু স্কেচ আর ওয়াটার কালারে করা কিছু ছবি এনেছি’। দেখে বললাম তোমার সব ছবি গুলো কি ধারার বুঝলাম না। এই প্রথম জানলাম সারিয়ালিস্মের কথা। অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল সারিয়ালিস্ম ব্যাপারটা কি। কথায় কথায় উঠে এলো অনেক নাম, যার মধ্যে অনেক নাম আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। ফ্রিদা, ডালি, পিকাসো এঁদের নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। একটা কথা বেশ মনে আছে, ও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল পিকাসোর পুরো নাম জানি কিনা? ‘হ্যাঁ, অবশ্যই জানি পাবলো পিকাসো’। হেসে বলেছিল ওর নামটা নাকি বিশাল ‘পাবলো ডিয়েগো জ্যো ফ্রান্সিস্কো ডি পওলা জুয়ান নেপোমিউসিনো মারিয়া ডি লস্‌ রেমেদিও্‌ সিপ্রিআনো ডি লা স্যান্টিসীমা ত্রিনিদা্‌ রুইযি ই পিকাসো’। ঐ সময়ে যাঁদের নাম বেশ বড়, তাদের নাম মনে রাখাটা একটা কেত ছিল। তাই ওখানে বসেই নামটা মুখস্ত করে নিলাম। বেশ কাটল দিনটা শর্মিষ্ঠার সাথে।

এরপর বেশ ঘনঘন দেখা হতে লাগল ওর সাথে। বেশ মনে পরে এক সময়ের কথা, সবে সময় বসন্তে পা দিয়েছে। ঋতু পরিবর্তনে যেমন জ্বরের একটা প্রভাব দেখা দেয়, ঠিক তেমনি সেই বছর অনেকের মতো আমি আর শর্মিষ্ঠাও জ্বরে পড়লাম। আসলে আমরা দোলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মন খারাপ হয়ে গেছিলো এই ভেবে যদি দোল না খেলতে পারি। দোলের আগে আমি বেশ সুস্থ হয়ে উঠলাম কিন্তু শর্মিষ্ঠার জ্বর সারল না। দোলের দিন সকাল বেলা এসে হাজির হল আমার বাড়িতে। গায়ে তখনও বেশ জ্বর। কোন কথা শুনল না আমার। আমাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে শান্ত হয়ে বসতে বলল। কথা মতো বাধ্য ছেলের মতো বসলাম। তারপর, ওয়াটার কালার আর আবির দিয়ে ও আমাকে বেশ সাজাল। আমাকে ওর মনের মতো করে সাজাবার পর ও বলল আমি যেন ওকে এবার আবির দি। আমি কিছুতেই রাজি নই, কারণ তখনও ওর গায়ে বেশ জ্বর। কোন কথাই সে শুনল না, অগত্যা ওকে ওর ইচ্ছা মতো লাল আবির দিয়ে সাজালাম। আমাদের বাড়ির ছাদে একে একে সব বন্ধুরা চলে এলো দোল খেলবে বলে। ও চুপ করে বসে আমাদের দোল উপভোগ করছিলো। খানিক বাদে উঠে এসে আমাকে ও বলল ও চলে যেতে চায় কারণ ওর শরীর খুব খারাপ লাগছে। আমি ওকে ওর বাড়ি অব্ধি পৌঁছে দিতে চাইলাম। কিন্তু ও রাজি হলনা এই বলে ‘অনেক হেঁটেছি তোমার সাথে, এবার একা হাঁটার পালা, তুমি আনন্দ কর’।

বিকেলে খবর পেলাম শর্মিষ্ঠা আর নেই। দোলের সেই বিকেলটা, শ্মশান আর শর্মিষ্ঠার শান্ত মুখটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আজও দেয়, পিকাসো, বসন্ত, ইচ্ছামতির নদীর পার।

স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।

যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।

বং ব্লগার

"বং ব্লগার" একজন আস্ত পাগল, অশিক্ষিত, জ্ঞানগম্য হীন ট্রাভেলার। পথের সম্বল সামান্য পুঁজি যা মাঝে মাঝে জোটেও না, আর মনে অজানাকে জানার ও দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়ত, সবটাই ভোরের স্বপ্ন, তাতে কি যায় আসে? হয়তো সবটাই কাল্পনিক, তাতেও কি কিছু যায় আসে? সবটা মিলিয়েই আমি চিৎকার করে বলতে চাই, আমি "বং ব্লগার"।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.