সত্যি বলতে, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার ৩ দিনের বেনারস ট্যুরটি গেল শেষ হয়ে। ওই তিনটে দিনের মধ্যে একদিন গেছিলাম রামনগর ফোর্টে। অবশ্য আমার হাতে সময়ও ছিল না, যে আরও কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাব। এত কম সময়ে ভালোভাবে বেনারস ও তার আশপাশ দেখে ওঠা সম্ভভ নয়। কিন্তু, ইচ্ছা রয়েছে সময় ও সুযোগ পেলে আর খানকয়েকবার বেনারস দর্শনের। রামনগর হল বেনারস জেলায় অবস্থিত এক ছোট্ট শহর এবং বেনারস থেকে মাত্র ১৪কিমি দূরে অবস্থিত। রামনগরের প্রধান আকর্ষণ হল কাশী নরেশের ফোর্ট।
ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গায় আরও অনেক ফোর্ট রয়েছে, হয়তো তাদের তুলনায় এটি অনেক ছোট। কিন্তু, ছোট হলেও, এটি খুবই সুন্দর এবং দেখার মতন একটা জায়গা। রামনগর ফোর্ট, ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে, তৎকালীন বেনারসের মহারাজা রাজা বলওয়ান্ সিং তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে, রামনগর ফোর্ট হল বেনারসের মহারাজা, অনন্ত নারায়ণ সিং এর বাসস্থান। অবশ্য, ১৯৭১ সালের পর “বেনারসের মহারাজা” এই উপাধির অবলুপ্তি ঘটেছে।
বেনারসে বা তার আশেপাশে, আমি যতগুলি স্থাপত্য দেখেছি তার অধিকাংশই চুনারের বেলেপাথর দিয়ে তৈরি। এই রামনগর ফোর্টও মাখন রঙের চুনারের বেলেপাথর দিয়ে তৈরি, মুঘল শৈলী মেনে তৈরি তার আলংকারিক অলিন্দ, প্যাভিলিয়ন এবং সুদৃশ্য বিশাল চত্বর। ফোর্টের ভেতরে যতগুলি ভবন আছে তা জমি থেকে অনেকটা উঁচুতে তৈরি করা, যাতে বন্যার কবল থেকে ফোর্টকে রক্ষা করা যায়। এর একদিক সাধারণ মানুষের দেখার জন্য খুলে দাওয়া হয়েছে এবং অপর দিকে মহারাজের বাসভবন আছে বলে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এখানে জেনে রাখা ভালো যে, প্যালেসের ওপর দুটি সাদা রঙের মিনার আছে আর সেই দিকেই রয়েছে মহারাজের নিজস্ব বাসভবন, আর ঠিক এর অপর প্রান্তে রয়েছে দরবার হল।
কি কি দেখবেন
ফোর্টের ভেতরে রয়েছে একটি প্রদর্শশালা, বেদব্যাস মন্দির এবং মহারাজের নিজস্ব বাসভবন।
প্রদর্শশালা – দরবার হল, যেটা আসলে ফোর্টের ভেতরে জনসাধারণ জন্য একটি হল, সেটাকেই বর্তমানে প্রদর্শশালা হিসেবে পরিবর্তিত করা হয়েছে। প্রদর্শশালাটি আরেকটি নামেও পরিচিত, সেটি হল সরস্বতী ভবন। মনে রাখবেন, প্রদর্শশালার ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখনও সম্পূর্ণ প্রদর্শশালা সিসিটিভি দিয়ে ঘেরা ছিলনা। তাই, ফটো তোলার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম। আসলে, এটা সব ফটোগ্রাফারের মধ্যেই থাকে, ছবিতোলা যেখানে নিষিদ্ধ সেখানেই ছবি তোলার শখ। যেমন কথা তেমন কাজ, আমি কিছু ছবি তুলেছিলাম। অবশ্য, এখন মনে হয় নিয়ম না ভাঙলেই পারতাম। এখানে আছে পুরাকালের বৃহৎ ও ব্যাপক অ্যামেরিকান গাড়ি, পালকি, বিভিন্ন রত্নখচিত সিডান চেয়ার, স্বর্ণ ও রৌপ্য অলঙ্কার, এবং কিছু বেনারসি ব্রোকেডের রাজকীয় পোশাক। এখানে একটি সুবৃহৎ অস্ত্রাগার আছে যা বিভিন্ন তলোয়ার, পুরনো বন্দুক, বিভিন্ন ধরনের খঞ্জর, সুসজ্জিত হুকা, কালো বাদ্যযন্ত্রের দ্বারা সঙ্কলিত। এখানের অনেক বন্দুক বিদেশে তৈরি।
এখানে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও বিরল জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত ঘড়ি আছে। ঘড়িটি একইসঙ্গে সময়, দিন, বছর, মাস, এবং সপ্তাহের পরিসংখ্যান বলে দেয়। এবং জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত সূর্য, চন্দ্র, ও বিভিন্ন গ্রহের বিবরণও দিয়ে থাকে, যদিও টা পড়া খুবই কঠিন। আমি অন্ত্যত অনেক চেষ্টা করেছি পড়তে, কিন্তু বুঝতে পারিনি যে কি করে গণনা করতে হবে। অবশ্য আপনার জন্য সহজ হতেও পারে। এখানকার প্রদর্শশালার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও মুল্যবান বস্তুটি হল, তুলসীদাস গোস্বামীর নিজের হাতে লেখা পাণ্ণ্ডুলিপি।
মনে রাখবেন, সম্পূর্ণ হলটি সিসিটিভির পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
বেদব্যাস মন্দির – ফোর্টের ঘাট থেকে একটু এগোলেই বেদব্যাস মন্দির অবস্থিত। এই মন্দির কিন্তু ফোর্টেরই সাথে যুক্ত। আমরা সকলেই জানি যে, বেদব্যাস ছিলেন সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণের রচয়িতা এবং এই মন্দিরটি তাঁর নামেই উৎসর্গিত। মন্দিরের ভেতরে তিনটি শিবলিঙ্গ আছে, যা তামার পাত দিয়ে মোড়া। এর মধ্যে একটি শিবলিঙ্গ বেদব্যাসের।
রামনগরের উৎসব
রামলীলা উৎসব – এটা ভারতবর্ষের সবথেকে বড় উৎসব। এটি আশ্বিন মাসে (সেপ্টেম্বর – অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রামনগরে রামলীলা একটু অন্যরকম ভাবে পালিত হয়। সম্পূর্ণ রামনগরকে একটি রামলীলার ময়দান হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। শহরের ভেতরে দুটি আলাদা আলাদা জায়গায় লঙ্কা ও অশোকবাটীকার জন্য মঞ্চ তৈরি করা হয়। এই রামলীলার সময় সম্পূর্ণ ফোর্টটিকে আলোকশিখায় সাজান হয়। বারানসির মহারাজ এই উৎসবে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন, বিশেষ করে যখন রামায়ণের ধারাবাহিকটি অনুষ্ঠিত হয়। রামলীলার বার্ষিক উৎসব টি প্রায় একমাসব্যাপী ফোর্টের পেছনের রাস্তায় অনুষ্ঠিত হয় এবং মহারাজ নিজের পারিবারিক ঐতিজ্য বজায় রাখেন এই অনুষ্ঠানে নিয়মিত যোগদান করে। উৎসব চলাকালীন একটি মিছিলে বিভিন্ন পুরাকালের রাজকীয় সামগ্রীর প্রদর্শনের রীতিও আছে।
রাজ মঙ্গল উৎসব – এটি আরেকটি উৎসব যা এই ফোর্টে অনুষ্ঠিত হয়। নৌকোর উপর সাধারণের নৃত্যগীত সমন্বয়ে পালিত হওয়া এই উৎসবটি আসলে অনেকগুলো নৌকোর মিছিল। মিছিলটি অসি ঘাট থেকে শুরু হয়ে গঙ্গাপাড় বরাবর চলতে থাকে। উৎসবটি বছরের ফেব্রুয়ারী ও মার্চের মাঝামাঝি সময়ে (ফাল্গুন) উদযাপিত হয়।
অন্যান্য কার্যকলাপ –
খাবার – রামনগর লস্যির জন্য বিখ্যাত যা ” রামনগরের লস্যি ” নামেও পরিচিত। ফোর্টের বাইরে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বিভিন্নরকম লস্যির দোকান রয়েছে। লস্যি টা খারাপ ছিলনা, তবুও দুর্ভাগ্যবশত সেটি আমার ভালো লাগেনি। যদিও সেটা মোটেও খুব খারাপ নয়, একবার এটা অবশ্যই ট্রাই করা উচিৎ।
রামনগরের হোটেল –
রামলীলা, রাজ মঙ্গল বা অন্য কোন অনুষ্ঠান ছাড়া হোটেল রামনগরে যথেষ্ট সহজলভ্য। সমস্ত ধরনের হোটেলই রামনগরে পাওয়া যায়। তবে আমার মতে, ওখানে থেকে যাওয়ার কোন মানে নেই, বরং অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত বারানসি বা সারনাথে ফিরে আসা।Sarnath প্রবেশের সময়সূচী :- M প্রদর্শশালা রোজ সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা অব্দি খোলা থাকে
প্রবেশ মুল্য :-
ভারতীয়দের জন্য – ২০ টাকা (প্রাপ্তবয়স্ক/ শিশু)
বিদেশিদের জন্য – ১৫০ টাকা
কি করে যাবেন
এই ফোর্টটি বারানসি থেকে ১৪ কিমি এবং বেনারাস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে ২ কিমি দূরে অবস্থিত যদি আপনি পন্টুন ব্রিজ, হয়ে যান। রামনগর ফোর্টে পৌঁছোবার বিভিন্ন উপায় আছে, যেমন সড়কপথ, জলপথ। কিন্তু আমি পরামর্শ দেব জলপথে নৌকোবিহার সহযোগে গঙ্গা নদীতট থেকে ফোর্টের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গঙ্গাবক্ষে যার প্রতিবিম্ব আপনাকে মোহিত করবে সেটি উপভোগ করতে করতে যাওয়া।
সড়ক পথ
বারানসি থেকে রামনগর ফোর্টের যোগাযোগ ব্যাবস্থা খুবই ভালো। আপনি বারানসি থেকে অটো বা গাড়ি পেয়ে যাবেন। আশেপাশের সমস্ত দর্শনিয় স্থান ও Sarnath ট্যুর করিয়ে অটো প্রায় ১০০০ টাকা নেয়। এবং নিজস্ব গাড়ি ভাড়া করলে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা নেয়।
জলপথ
ফোর্টটি তুলসী ঘাটের ঠিক উল্টোদিকেই অবস্থিত, এবং এটি অসি ঘাট থেকে শুরু, তাই আপনি অনায়াসে একটি নৌকো ভাড়া করেও ফোর্টে যেতে পারেন। সমস্ত ঘাট দর্শন করিয়ে নৌকোভ্রমণে প্রায় ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা নিয়ে থাকে। তবে আপনাকে একটু দরাদরি করে নিতেই হবে।
আকাশপথ
কাছাকাছি বিমানবন্দর বলতে বারানসি বিমানবন্দর যা লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামেও পরিচিত। এটি বাবাতপুর, যা বারানসি শহরের প্রায় ১৮ কিমি উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত।
রেলপথ
কাছাকাছি রেলস্টেশন টি হল, বারানসি ক্যান্টনমেন্ট, এবং তারপর ওখান থেকে অটো/ ট্যাক্সি / ভাড়া গাড়ি আপনাকে নিতে হবে পৌঁছোবার জন্য।
সম্পূর্ণ অ্যালবাম টি দেখুন
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ– অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে চাই সম্রাট দে সরকারকে, কারণ তার সাহায্য ছাড়া আমার একার পখ্যে রামনগর দর্শন সম্ভব হতো বলে আমার মনে হয়না। আর, পঞ্চতপা কে ধন্যবাদ জানাতে চাই তার সাহায্য করার জন্য।
যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।