মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি ও তরু দত্ত

কয়েক বছর আগে, এক রবিবারের সকালে আমি আর সম্রাট বেরিয়েছিলাম স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করতে। সপ্তাহ শেষে, হাতে ক্যামেরা নিয়ে বেড়ানটা বহু দিনের অভ্যাস। অভ্যাসমত, বেড়িয়ে পরলাম রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক হল, লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে ছবি তুলতে যাবো। সেই মত ছবি তুলতে তুলতে পৌঁছলাম মানিকতলায়। ডকুমেন্ট করা যায় এমন ছবি তোলার দিকে আমার মন থাকে বেশী আর ক্রিয়েটিভ ছবি তোলার দিকে নজর থাকে সম্রাটের। তবে আমাদের একটা কমন্‌ ইন্টারেস্ট এর জায়গা হলো কলকাতা বা যে কোন জায়গার হেরিটেজ। মানিকতলা মোড় থেকে একটু দুরে গিয়ে হঠাৎই চোখ পড়লো গাছপালায় ঢাকা মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি এর দেয়ালে। রং চটা গোলাপি দেওয়ালের গায়ে খোদাই করে লেখা মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি। ভেতরে ঢুকে খানিকটা অবাক হতে হলো – একি এতো কোন কবরখানা নয়, এতো সম্পূর্ণ একটা ছোটখাটো জঙ্গল।

Entrance of Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Entrance of Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata

খচাখচ্‌ ছবি তুলতে শুরু করল সম্রাট কিন্ত আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তম্বিত হয়ে গেলাম। মাথায় ঘুরতে শুরু করল এখানে কাদের কাদের কবর আছে এবং সেটা খুঁজে বার করতে হবে। বেরিয়ে পরলাম ওখান থেকে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম “মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি” টা কোথায়। এক পরিচিত ভদ্রলোক মানিকতলায় থাকেন, তাকে ফোন করলাম, জানার জন্য। সবার থেকেই উত্তর পেলাম ”জানা নেই”। সে কি কথা ? আসেপাশের মানুষজন জানেনা এখানে একটা আস্ত কবরখানা আছে ? আবার ফিরে গেলাম সেখানে। জঙ্গল সরিয়ে খোঁজা শুরু করলাম কবর। বর্ষাকাল তখনও যায়নি, তাই কাদা মাখার সাথে সাথে সাপের ভয়ও ছিলো। কিন্ত কোন উপায়ও তো ছিলনা। বেশ খানিক খোঁজার পর চোখে পড়লো তরু দত্ত ও তাঁর পরিবারের অনেকের কবরের ওপর। সে কি ? তরু দত্ত মানে তরুলতা দত্তের কবর এই অবস্থায় ? কবরের ওপর ভাত, মাছের কাঁটা, প্লাস্টিক কিছুই বাদ নেই। নোংরায় ঢাকা সবকটা কবর। কি আর করা ? নিজের কৌতূহল মেটাতে হলে পরিষ্কার করতে হবে জায়গাটা। অগত্যা, সামান্য পরিষ্কার করলাম, তাতে সম্রাটও হাত লাগালো। আসতে আসতে চেষ্টা শুরু করলাম কার কার কবর আছে ওখানে, তা জানার। তরু দত্ত, তাঁর পিতা গোবিন্দ চন্দ্র দত্ত ও তার মা ক্ষেত্রমণি দত্ত। তার আরেক কন্যা অরু দত্ত এবং তার পুত্র অব্জু দত্তের কবরও আছে এখানে। বেশ কিছু বছর আগে “পথের পাঁচালি” নামক এক এনজিও এই কবর গুলকে সারাইয়ের কাজ করেছিল। কিন্ত তাও এখন প্রায় নষ্টের মুখে। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো ওখানে। এছাড়া আর কোন রকম তথ্য আবিস্কার করতে পারলাম না। মনেমনে গজগজ করতে করতে ফিরে এলাম বাড়ি। এসেই ফোন করলাম সুমিতকে, বললাম সব কথা। এই শুনে সুমিত অবাক হয়ে গেলো এবং কবর গুলির বর্তমান অবস্থার কথা শুনে ওরও মনখারাপ হয়ে গেলো। ঠিক করলাম আবার যেতে হবে। যে করে হোক এই জায়গাটার হাল ফেরাতে হবে।

Graves of Dutt Family in Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Graves inside Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Graves inside Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata

এবার একটু তরু দত্তের সম্পর্কে দু এক কথা বলে নেওয়া যাক। রামবাগানের এই দত্ত পরিবারের সদস্যদের একাংশ ১৮৬২ সালে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহন করে।পরিবার ভাঙ্গে, দুটি বাড়ির একটি খ্ৰীষ্টান দত্তবাড়ি ও অন্যটি হিন্দু দত্তবাড়ি নামে পরিচিত হয় এলাকায়। এবার আসি তরু দত্তের কথায় , তরুলতা দত্তের জন্ম ৪ঠা মার্চ ১৮৫৬। ছোট বেলা থেকেই পিতা গোবিন্দ চন্দ্র দত্ত তাঁর বিদূষী মেয়ের প্রতিভার পরিচয় পান এবং তাকে ছোটবেলা থেকেই ইংরাজি ভাষার সাথে সাথেই ফরাসি ভাষারও তালিম দিতে শুরু করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তরু ফরাসি ভাষায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড এ যান এবং সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুন করেন। পরবর্তীকালে, তিনি বহু ফরাসি সাহিত্যের ইংরাজি অনুবাদ করেন। খুব কম বয়সেই, তিনি হয়ে ওঠেন ফরাসি, ইংরাজি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শীনি। আসলে উনি খুব অল্প বয়সেই খুব বড় মাপের ভাষাবিদ্‌ হয়ে ওঠেন। তার লেখা বিদেশে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়। তার লেখা অনেক কবিতা, বিশেষ করে ‘সীতা’, ‘লোটাস’ ও ‘আওয়ার ক্যাসুরিনা ট্রি’ আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার সাফল্যের কোন অংশই তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। মাত্র ২১ বছর বয়সে, ১৮৭৭ সালের ৩০ শে অগাস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়। আপনারা যদি তাঁর লেখা কবিতা বা অনুদিত কবিতা পড়তে চান সেক্ষেত্রে প্রোজেক্ট গুটেনবার্গ বা ইন্টারনেট আর্কাইভ্‌ দেখতে পারেন।

যে প্রশ্ন গুলো আমাকে ভাবাচ্ছিল, তা হলো – আর কাদের কাদের কবর রয়েছে এখানে ? কবেই বা এই কবরস্থান স্থাপিত হয়েছিলো ? কারা এই কবরস্থানের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্তে আছে ? তারাই বা কেন এত উদাসীন ? নানান প্রশ্ন ভিড় করে আসতো। কিন্ত আমার যে কিছু করার ছিলনা। কারণ কে শুনবে আমার কথা ? শুরু করলাম নিজের মত করে প্রচেষ্টা। খুঁজে দেখলাম, এই কবরস্থান সম্পর্কে কোন ইন্‌ফর্মেশন ইন্টারনেটে পেলামনা কিন্তু তরু দত্ত নিয়ে কিছু কিছু ইন্‌ফর্মেশন পেলাম। তাও যথেষ্ট ছিলনা। যাইহোক, আমার ব্লগে তরু দত্ত ও এই মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি নিয়ে একটা লেখা লিখলাম। চেনা ও কিছু অচেনা মানুষের বাহবা ছাড়া আর কিছুই জুটল না, মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি-এর ভাগ্যে। মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রির যে অবস্থা ছিল তাই রয়ে গেল। মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি ও তরু দত্তকে নিয়ে যদি অন্য কোন “বিখ্যাত” ব্লগারা লেখে তাহলে এটার অবস্থার যদি উন্নতি হয়। এই ভেবে, আমার চেনা ব্লগারদের বলা শুরু করলাম। কেউ আমার কথায়, সত্যি বলতে পাত্তাই দিলনা। আসলে, আমার বুঝতে ভুল হয়েছিলো, গ্ল্যামার নেই মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রির, তাই তাদের লিখে কি লাভ। পরবর্তীকালে, তারাই তরু দত্ত নিয়ে থিসিস এর মত ব্লগ লিখেছে। কেউ কেউ তো, ফুটেজ পাবার জন্য ফুলমালা নিয়ে তরু দত্তের কবরে হাজির হয়েছে।

যাইহোক, যখন কোন দিক থেকেই কিছু করে উঠতে পারছিলাম না। তখন, সাহায্যের জন্য কলকাতার তৎকালীন বিসপ্‌কে আমি ফোন করি। হাসি মুখে তিনি আমার পরিচয় ও ফোন করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মন দিয়ে শোনেন। ওনাকে আমি অনুরোধ করি অন্তত আমাকে মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি সম্পর্কে কিছু ইন্‌ফর্মেশন দেবার জন্য। তিনি আমাকে রেভারেন্ডঃ আবির মজুমদারের সাথে কথা বলিয়ে দেন এবং তার সাথে যোগাযোগ রাখতে বলেন , আমাকে তিনি তথ্য দেবেন বলে সম্মতও হন। পরবর্তীকালে, তিনি আমাকে কোন ইন্‌ফর্মেশন তো দেনইনি, উপরন্ত তিনি আমার ফোন তোলাও বন্ধ করে দেন।

নিজে খানিকটা চেষ্টা করে কিছু কিছু তথ্য বার করি। তরু দত্ত ও তাঁর পরিবারের কবর ছাড়াও বিখ্যাত চিকিৎসক ডঃ ললিত মোহন ব্যানার্জি-এর কবর ওখানে রয়েছে। বলে রাখা ভাল, এই কবরস্থানটি “চার্চ মিশান সোসাইটি সিমেট্রি” হিসাবে নথিভুক্ত। মার্চ ২০০৭ সালে “পথের পাঁচালি” ও তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী শ্রী সুভাষ চক্রবর্তীর যৌথ উদ্যোগে তরু দত্তের কবর সহ তাঁর পরিবারের সবার কবরের পুনরূদ্ধার করা হয়েছিলো। তার পর আর বিশেষ কিছু করা হয়নি। গত ৬/৭ মাস আগে একবার জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়, কিন্ত বর্তমানে আবার তা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

Grave of Toru Dutt in Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Graves of Dutt Family in Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Tomb Stone of Abuj Dutt in Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Marbel Plaque of Resotoration of Graves of Dutt Family in Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata Graves inside Maniktalla Christian Cemetery, Kolkata

কি ভাবে যাবেনঃ মানিকতলা মোড়ে নেমে ২/৩ মিনিট হাঁটা পথে পৌঁছে যান কুষ্ঠ হাসপাতাল, ঠিক এর পিছন দিকে রয়েছে এই কবরস্থান।

তরু দত্তকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র খুঁজে পাই ইউটিউবে সেটির লিঙ্ক দিলাম।

https://www.youtube.com/watch?v=VSZXOzcispM

ঠিকানা :- ২৫৯বি আচার্যা প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা।

 

স্বত্ব © বংব্লগার আপনার যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে আপনি এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু দয়াকরে এর লেখকের নাম ইন্দ্রজিৎ দাস উল্লেখ করতে ভুলবেন না। ভুলে যাবেননা চৌর্যবৃত্তি মহাদায়, যদি পড়েন ধরা।

যদি আপনি আপনার নিজের ছবি এখানে দেখতে পান এবং তাতে যদি আপনার কোন রকম আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্যই ই-মেল করে আপনি উপযুক্ত প্রমাণসহ আপনার দাবি জানাতে পারেন।দাবিটি ন্যায্য প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হবে।

 

বং ব্লগার

"বং ব্লগার" একজন আস্ত পাগল, অশিক্ষিত, জ্ঞানগম্য হীন ট্রাভেলার। পথের সম্বল সামান্য পুঁজি যা মাঝে মাঝে জোটেও না, আর মনে অজানাকে জানার ও দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়ত, সবটাই ভোরের স্বপ্ন, তাতে কি যায় আসে? হয়তো সবটাই কাল্পনিক, তাতেও কি কিছু যায় আসে? সবটা মিলিয়েই আমি চিৎকার করে বলতে চাই, আমি "বং ব্লগার"।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 + nineteen =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.